অমনি টিয়া বলল, আমারও মামণি, বাপি, আম্মা, ঠামু আর নোনোর জন্যে মন কেমন করে? বলেই ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ল। তাই দেখে ঘড়িওলা বেজায় বিরক্ত, কথায় কথায় অত চোখের জল কীসের গা? দামোদর নদী নাকি! এত করে বললাম–মাকুকে খুঁজে দাও, হ্যাঁন্ডবিল পর্যন্ত দিলাম, অথচ খোঁজার নামটি নেই!
টিয়া চটে গিয়ে কান্না থামিয়ে সবে বলেছে, মাকু তো–, অমনি সোনা তার ঠ্যাং ধরে টেনে গাছের ডাল থেকে নীচে নামিয়ে আনল, গুঁড়িতে মাথা ঠুকে আলু হল, এবার কান্না থামতে পাঁচ মিনিট।
কান্না থামলে ঘড়িওলা আবার বললে, মাকুর চালাকি এবার বের করছি, কতকগুলো চাকা আর স্প্রিং আর চকমকি ইত্যাদির তেজ দেখো-না! এবার সব যন্ত্রপাতি খুলে আলাদা আলাদা থলেয় পুরে বাছাধনকে—
হোটেলওলা শেষের কথাগুলি শুনে অবাক হয়ে গেল।
–কেন গো, মাকু না তোমার প্রাণের কলের পুতুল, মানুষ থেকে যার কোনো তফাত নেই, অথচ মানুষের চেয়ে যে শতগুণে ভালো, যেমনটি বানিয়েছ তেমনটি করে, আমাদের ছেলেপুলের মতো তাঁদড় নয়– আজ আবার উলটো কথা শুনি কেন?
ঘড়িওলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, এখন আর তা নয়, দাদা, যেমনটি ভেবে বানিয়েছিলাম, এখন আর তা নেই। কলের মধ্যে কী যেন অন্য শক্তি গজিয়ে গেল, মাকু এখন ইচ্ছেমতো চলে বলে, আমার বড়ো-একটা তোয়াক্কা রাখে না। আমার প্ল্যানমতো যদি চলত, এমন বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যেতে পারত কখনো? অবশ্যি আমিও মোটেই চাইনে যে সে আমাকে খুঁজে পায় অমনি তো কাদার কল করে আর তিষ্ঠুতে দেবে না। নেহাত এত দিনেও তোমরা কেউ তাকে দেখতে পাওনি বলেই বুঝেছি এ-বনে সে নেই, তাই দু-দণ্ড বসে গল্প করছি! ব্যাটাকে পেলে ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে ওর গায়ের কোনো দু-টুকরো একসঙ্গে রাখব না। সোনা-টিয়া শিউরে উঠল।
হোটেলওলা বলল, এত রাগ কীসের?
–হবে না রাগ? সতেরো বছর ধরে, বাড়িঘর ছেড়ে, মার রান্না ছেড়ে, ঘড়ির কারখানায় যে পড়ে রইলাম সে তো শুধু মাকুর জন্যই। নইলে ম্যানেজার আমাকে উদয়াস্ত খাঁটিয়ে ঘড়ির ঘরের তাকের নীচে শুতে দিয়েছে আর ছাইপাঁশ খেতে দিয়েছে। তাইতেই আমি সারারাত জেগে গুদোমে পড়ে-থাকা রাজ্যের পুরোনো বিলিতি ঘড়ির কলকজা খুলে নিয়ে, ওর পেটে পুরতে পেরেছি। ফালতু পড়ে ছিল যে জিনিস, মরচে ধরে নষ্ট হচ্ছিল, কেউ দেখছিল না, এখন শুনছি তারি দাম নাকি পাঁচ হাজার টাকা! ওই পাঁচ হাজারের জন্য আমার নামে হুলিয়া বেরিয়েছে। এবার চাবি ফুরুলেই দেব পুতুলটাকে যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে, ধুয়ে খাক, আমার কী?
এই বলে ঘড়িওলা দু-বার চোখ মুছল। হোটেলওলা বলল, অত ভাবনা কীসের বুঝি না। ছ-মাস মাকুর খেলা দেখালে অমনি তোর কত পাঁচ হাজার উঠে আসবে, তখন পাঁচের বদলে সাত হাজার দিয়ে কলকজাগুলো কিনে নিতে পারবি!
ঘড়িওলা হাত-পা ছুঁড়ে চাচাতে লাগল, কোন চুলোয় খেলা দেখাবটা শুনি? রঙ্গমঞ্চটা কোথায়? সার্কাসপার্টি নিখোঁজ, অধিকারী ফেরারি, না আছে তাবু না আছে গ্যাসবাতি, পালোয়ানরা সব জন্তুজানোয়ার নিয়ে বনের মধ্যে সেঁধিয়েছে। ওকথা আর মুখে এনো না কাপ্তেন–।
মালিক তাকে কাছে ডেকে বোঝাতে লাগল, এই সুযোগে টিয়ার হাত ধরে পা টিপে টিপে সোনা বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। মাকুকে সাবধান করে দিতে হবে।
টিয়া বললে, মাকু যদি কথা না শোনে?
সোনা গম্ভীর হয়ে গেল, মাকুকে বাঘ ধরার ফাঁদে ফেলে দেব আর উঠতেও পারবে না, কেউ খুঁজেও পাবে না!
টিয়ার কান্না পেল, আর যদি বেরুতে না পারে? শেষটা যদি খেতে না পেয়ে—
চুপ, টিয়া চুপ। ঘড়িওলা চলে গেলে জাদুকর দড়ি দিয়ে মাকুকে তুলে আনবে। ছি, কাঁদে না, আজ-না মালিকের জন্মদিন? সঙের লটারির টিকিটের আধখানা খুঁজে দিতে হবে-না? আজ যে জানোয়ারদের খেলা হবে, মালিকের জন্মদিন বলে কত রান্নাবান্না হচ্ছে দেখলে না?
টিয়া ঢোক গিলে বলে, বড়ো গর্তে ফেলবে না ছোটো গর্তে ফেলবে। মাকুর লাগবে না?
সোনার হাসি পায়, কলের পুতুলের আবার লাগে নাকি? লাগলে লোকেরা কাঁদে, মাকুর কাদার কলই নেই তো কঁদবে কী?
টিয়া বললে, তা হলে বড়ো গর্তেই ফেলে দাও, নইলে যদি আবার বেরিয়ে এসে বলে, এই যে আমি মাকু, আমাকে কাদার কল দাও!
সোনা একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি মাকুকে কাঁদার কল দেব। মাকু আমাদের জন্য প্যা-পা পুতুল জাদুকরের কাছ থেকে এনে দেবে আর আমি ওকে কাদার কল দেব না?
টিয়া তো অবাক, আছে তোমার কাছে?
সোনা বুক ফুলিয়ে বললে, নেই, কিন্তু বানিয়ে দেব। ওর মুন্ডু খুলে তার ভেতরে কাঁদার কল বসিয়ে দেব। মাকু তখন তোর মতো ভ করে কাদবে!
বলতে বলতে সত্যি সত্যি দু-জনে বাঘধরার বড়ো ফাঁদের কাছে এসে গেল। অনেক দিনের পুরোনো ফাঁদ। বনে যখন বসতি ছিল তখন গাঁয়ের লোকরা বাঘ ধরবার জন্য করেছিল। জাদুকর বলেছিল, বাঘ মোটেই নয়, বুনো শুয়োরে ওদেরশস্য খেয়ে ফেলে নষ্ট করত, তাদের ধরবার ফাঁদ এগুলো। মাটিতে দু-মানুষ গভীর গর্ত খুঁড়ে তার ওপরে কাঠকুটো লতা-পাতা দিয়ে ঢেকে রাখত, শস্য খেতে এসে তার মধ্যে শুয়োর পড়ে যেত আর শস্য খাওয়া ঘুচত। তাই শুনে শুয়োরের জন্য টিয়া একটু কেঁদেও নিল।
এখন ফাঁদের মুখটা লতাপাতা গজিয়ে ঢেকে গেছে, না দেখে কেউ পা দিলে ঘপাৎ করে পড়ে যাবে।