হোটেলওলা আর মাকু দু-জনে ছুটে এসে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে, বাতাসা খাইয়ে টিয়ার কান্না থামিয়ে ওদের স্নানের জোগাড় করতে চলে গেল। গাছ-ঘর থেকে সাবান এল, গামছা এল, রান্নার তেল থেকে তেল ঢেলে গায়ে মাখা হল। তারপর হোটেলওলা পায়েস রাঁধতে বসল। ছোটো নদীর জলে ওরা স্নান করল, মাকু গামছা দিয়ে গা মুছিয়ে দিল। পুঁটলি থেকে পাউডার বের করে ওরা মুখে সাদা করে মেখে নিল, আম্মার ভাঙা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে, মাকুকে বলল, ভাত দাও।
অমনি হোটেলওলা আর মাকু গাছের গুঁড়ি সোজা করে, তার ওপর তক্তা পেতে টেবিল বানিয়ে ফেলল। কানা-তোলা কাঠের থালায় সোনা-টিয়াকে স্টু-ভাত এনে দিল।
চারিদিকে পায়েসের গন্ধে মো-মো করছে, আর দলে দলে সার্কাসের লোকেরা খাবার জন্যে হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির। হোটেলওলা পায়েসের কড়াইয়ের ওপর বারকোশ চাপা দিয়ে বলল, এ বেলা খালি স্টু-ভাত, কই, পয়সা দেখি। পায়েস আর ভুনিখিচুড়ি মাংস ওবেলা পাবে, মাগনা– বিনি পয়সায়।
চারিদিকে খালি চাকুমচুকুম, তারি মধ্যে উঠি-পড়ি করে সং এসে হাজির। তার চুল সব খাড়া, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, ফোঁসফোঁস নিশ্বাস পড়ছে, জামাকাপড়ে ধুলোবালি শুকনো পাতা। ধপাস করে একটা গাছের গুঁড়িতে বসে পড়ে সে বললে, সর্বনাশ হয়েছে, সব বোধ হয় জানাজানি হয়ে গেল। বনে পেয়াদা সেঁদিয়েছে!
সঙ্গেসঙ্গে যে-যার থালা-বাটি নিয়ে দুড়দাড় করে কোথায় যে গা ঢাকা দিল কে বলবে। নিমেষের মধ্যে বটতলা ভো-ভা, ভিড়ের সঙ্গে মাকুও হাওয়া! জিনিসপত্র যেখানকার যেমন পড়ে রইল, হোটেলওলা সোনা-টিয়াকে নিয়ে তরতর করে গাছ-ঘরে গুম হল।
০৫.
গেছো-ঘরে শুধু চুপচাপ বসে থাকা, নিশ্বাস বন্ধ করে, কান দুটোকে খাড়া করে। কিছু দেখা যায় না, গাছের পাতার ঘন ঝালর গেছো-ঘরকে আড়াল করে নিরাপদে রাখে। সোনা-টিয়াও কিছু দেখতে পায় না। খালি মনে হয় নীচে কেউ পট পট মট মট করে হেঁটে বেড়াচ্ছে, ছোঁক ছোঁক করে শুকছে। খিদেয় ওদের পেট চোঁ চোঁ করে।
একটু পরে লক্ষ করে গেছো-ঘরের দেয়াল ঘেঁষে এক পাশে কালো চাদর মুড়ি দিয়ে কে শুয়ে আছে, ভয়ে সোনা-টিয়ার হাত-পা ঠান্ডা হয়! এই সেই কালিয়ার বনের ভয়ংকর নয় তো, যার গা থেকে বন্দুকের গুলি ঠিকরে পড়ে যায়? হোটেলওলার দু-হাঁটুতে মুখ গুঁজে দু-জনে কাঠ হয়ে পড়ে থাকে। হোটেলওলা ওদের পিঠে হাত বুলিয়ে অভয় দেয়।
গেছো-ঘরের কেঠো মেঝের ফুটোতে চোখ লাগিয়ে হোটেলওলা দেখে কেউ কোথাও নেই, সব নিরাপদ। কালো মানুষটাকে ঠেলা দিয়ে বলে, পেছন পেছন রাজ্যের বিপদ টেনে নিয়ে আসিস কেন?
কালো-কাপড় রেগে যায়, চাদর ফেলে উঠে বসে বলে, তা আসব না? আমি না এলে রোজ রোজ কে তোমার গোঁফ-দাড়ি সরবরাহ করবে শুনি?
টিয়া বললে, কেন, সং করবে। ও তো রোজ পোস্টাপিসে যায়!
লোকটি চটে গেল। রেখে দাও তোমাদের ন্যাকা সঙের কথা। কবে এক টাকা দিয়ে লটারির টিকিট কিনে বসে আছে, তাই দিয়ে নাকি সে বড়লোক হবে! এদিকে গুণের তার অন্ত নেই। যেই পোস্টমাস্টার ছোটো জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, কই, না তো, খবরের কাগজে লটারির কথা লেখেনি তো! অমনি ডুকরে কেঁদে পিটটান দেয়! ও কী দাদা, হল কী?
হোটেলওলা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে গেছো-ঘরে খোঁজাখুঁজি লাগিয়ে দিল। সোনা বলল, কী হারিয়েছে তাই বলোনা, টিয়া খুব ভালো খুঁজে দেয়। মামণির চাবি খুঁজে দিয়েছিল।
টিয়া অমনি ভ্যাঁ করে কেঁদে বলল, মামণির কাছে যাব। আমার খিদে পেয়েছে! কান্না দেখে হোটেলওলা আর কালো লোকটা সোনা-টিয়াকে কোলে করে নামিয়ে এনে আবার খাবারের বাটির সামনে বসিয়ে দিল। এতক্ষণে সোনা-টিয়া চিনতে পারল–ওই-না ঘড়িওলা! আঁ, ঘড়িওলা, তুমি কেন এলে? তোমাকে দেখলে কাদার কলের জন্য চেপে ধরবে-না?
ঘড়িওলা বললে, এই, চুপ, চুপ!
কথাটা অবিশ্যি হোটেলওলার কানে যায়নি, সে নীচে নেমেই আবার কী যেন খুঁজতে আরম্ভ করেছে! খানিক বাদে ফিরে এসে মাথায় হাত দিয়ে গাছের গুঁড়িতে বসে পড়ল। সর্বনাশ হয়েছে, সং তার লটারির টিকিটের আধখানা আমাকে রাখতে দিয়েছিল, কানে খুঁজে রেখেছিলাম, কোথায় পড়ে গেছে। এখন সেটিকে কিছুতে যদি খেয়ে ফেলে থাকে, তবেই তো গেছি! ও টিয়া, সত্যি খুঁজে দেবে তো?
টিয়া বলল, দেব, দেব, খেয়ে-দেয়ে, হাত-মুখ ধুয়ে, খুঁজে দেব। ঘড়িওলা বনের মধ্যে কেন এলে?
হোটেলওলা বলল, বাঃ, তা আসবে না? ও যে আমার ছোটো ভাই, নইলে দাড়ি আনবে কে? তা ছাড়া ওকে কলের পুতুল খুঁজে বেড়াতে হয়, এদিকে নিজের দেখা দেবার জো নেই। তার খাটনি কত? মাঝে মাঝে স্বর্গের সুরুয়া খেয়ে না গেলে পারবে কেন?
টিয়া বলল, কিন্তু–কী
সোনা হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরল, এই, চুপ, চুপ।
হোটেলওলা আবার উঠে টিকিট খুঁজতে লাগল।
ঘড়িওলা বলল, আর পারি নে! বলি, তোফা আছ এখানে আমার দাদার আস্তানায়, মাকুর হদিশ পেলে? তা ছাড়া তোমাদের সঙ্গে বেহারি বলে যে লোকটা এসেছে, আশা করি তার কাছে আবার হাঁড়ির কথা ভাঙনি?
টিয়া সত্যি কথাই বলল, বেহারি আমাদের চাকর, আমাদের বাড়িতে বাসন ধোয়। মাকুকে পেলে কী করবে? হাসি-কান্নার কল এনেছ?
ঘড়িওলা রেগে গেল। রাখো তোমাদের হাসি-কান্নার কল। তা ছাড়া একটু একটু হাসতে পারে মাকু, ঠোঁটের কোণের কজা খুললেইমুখটা হাসি-হাসি দেখায় আর কান্নার কলটল করা আমার কম্ম নয়। আমার পয়সাকড়ি বিদ্যে বুদ্ধি সব গেছে ফুরিয়ে। এবার মাকুকে একবার পেলে হয়, সটান থানায় দিয়ে দেব। আর ফেরারি হয়ে ঘুরতে ভালো লাগে না। মা-র জন্য মন কেমন করে।