কিন্তু কে কার কথা শোনে! জগদীশদা বোধ করি পিসিমার সঙ্গেই এসেছিল, ব্যাপার দেখে কেমন ঘাবড়ে গিয়ে এতক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারছিল না। এবার ঢোক গিলে বললে, আঃ, পিসিমা! তুমি তো আচ্ছা ফ্যাসাদ বাধালে দেখছি! গুটে থেকে নেপু পর্যন্ত সবাইকে সন্দেহ করলে কী করে চলে!
কী কষ্টেই যে শেষ অবধি পিসিমাকে ঠান্ডা করা হল সে আর কী বলব।
নেপু সেই যে কেটে পড়ল আর তার দেখা নেই। শেষপর্যন্ত আমাকে সারাদিনের সব ঘটনা খুলে বলতে হল। মা পিসিমার হাতে কতকগুলো কচি কচি মটর শাকের গোছা গুঁজে দিতে দিতে বললেন, কী কী তোমার হারিয়েছে দিদি, বুঝলাম না। এই শুনি কৌটো গেছে, আবার এখন বলছ সোনার গয়নাও গেছে! কী জানি!
পিসিমা মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বললেন, তবে কি আমি মিছে কথা বলছি নাকি, মেজোবউ? যার কৌটো গেছে তার কি গয়না যেতে নেই?
বলেই পিসিমার এমনি বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল যে তাকে ধরাধরি করে শোয়ানো হল আর শংকর ছুটে গিয়ে ওঁদের বাড়ি থেকে গুরুদেবের চরণামৃত এনে দিল তবে-না রক্ষে।
০৫.
সেকালে বড়োদিনের বারো দিন করে ছুটি থাকত। একে একে তার প্রায় সবগুলিই কেটে গেল। সে যে কী ভীষণ শীত সে আর বলা যায় না। দূরে দূরে পাহাড়ের মাথায় সাদা সাদা বরফ জমে থাকতে লাগল। ঘুম থেকে উঠে রোজ দেখতুম হিম জমে বরফ হয়ে গিয়ে চারদিক সাদায় সাদা। ছোটো ছোটো পাহাড়ে নদীগুলোর ওপর এক পরত বরফ খুদে খুদে ঢেউসুদ্ধ জমে রয়েছে।
তারপর একটু রোদ উঠলেই সব বরফ গলে যেত। তখন শুধু ডালপালা থেকে টুপটাপ জল পড়ত।
অন্য বছর এ-সময় অনেকেই পাহাড় থেকে নেমে যেতেন। চারদিক নিঝুম হয়ে যেত। আমরা ক-ঘর বারোমেসে বাসিন্দারা এখানে ওখানে টিমটিম করে বেড়াতুম। বিকেল হতে-না-হতেই সন্ধ্যে নেমে যেত, শীতের চোটে সবাই গিয়ে ঘরে উঠতুম।
এ-বছর কিন্তু সবই আলাদা রকমের হল। শহর ছেড়ে যেতে কাকেও অনুমতি দেওয়া হল না, পাছে সেইসঙ্গে চোরাই মালও পাচার হয়ে যায়।
গাছের পাতা সব লাল-হলুদ রং ধরে শেষটা খসে পড়ে গেছে। সবাই ছোটা ছোটো গোল গোল লোহার আংটা কিনে তাতে কাঠকয়লা জ্বেলে, সকাল-সন্ধ্যে হাত-পা সেঁকে আরাম করতে চায়।
এ-বছর আমাদের স্কুলের বোর্ডিং থেকে কেউ যাবার অনুমতি পায়নি। বাৎসরিক পরীক্ষাও হয়ে গেছে, নতুন বছরের পড়া শুরু হয়নি, কাজেই সবার হাতে দেদার অবসর। সেই সুযোগে এবার একটু আগে আগেই ইস্কুলের জন্মদিন করা হল।
খুব কষ্ট হল, শহরসুদ্ধ সকলের প্রায় নেমন্তন্ন হল, মেলা চাঁদা তোলা হল। বাইরে বড়ো ঠান্ডা, সেখানে কানাত ফেলে উৎসব করলে সকলে শীতে কষ্ট পাবে। তাই আমাদের মস্ত হল ঘরের স্টেজে লক্ষ্মীর পরীক্ষা অভিনয় হল।
হলের ও-পাশ দিয়ে একটা সরু লম্বা ঢাকা বারান্দা। তার অন্য মাথায় সাজের ঘর। দামি দামি কাপড়-চোপড়ে ঠেসে রয়েছে।
সেকালে ওখানে আর পোশাক ভাড়া করার ব্যবস্থা ছিল না, তা ছাড়া ভাড়াকরা পোশাক কেউ পরতও না। কাজেই যে যার বাড়ি থেকে ভালো ভালো সব গরদ, মাদ্রাজি, বেনারসি এনেছিল। অবিশ্যি গয়নাগাটি সব পেতলের আর কাচের। বাবা! ইন্দুদির ক্লাসের সেই ব্যাপারের পর থেকে কার বাড়ির লোকেরা আর মেয়েদের হাতে গয়না দেবে!
মঞ্জিরা কেউ কেউ বড়োমানষি দেখিয়ে জড়োয়া গয়না আনতে চেয়েছিল, কিন্তু ইন্দুদি তাই নিয়ে খুব রাগারাগি করাতে আর আনেনি।
সারাদিন ধরে ধুমধাম চলল। বেলা এগারোটা থেকে খেলাধুলো। বিকেলে বাগানে বক্তৃতা। লাবণ্যদি একটা সাদা রেশমি শাড়ি পরে ইস্কুলের জীবনী পাঠ করলেন। পরির মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল। তারপর চা, মিষ্টি, কমলা লেবু খাওয়া হল। তখনকার দিনে জিনিসপত্র সস্তা ছিল। পয়সা পয়সা করে এই বড়ো বড়ো কমলা লেবু পাওয়া যেত।
নেপুদের দলও গেছল। ওদের অপূর্বদা দেখলুম সেজেগুঁজে এসে, গোঁফ নেড়ে নেড়ে লাবণ্যদির সঙ্গে ভারি ভদ্রতা করে এলেন! দেখেই আমার গা জ্বলে গেল। কানের ফুলের কথা এতদিনে পুলিশে ডাইরি পর্যন্ত হয়ে গেছে, তবুলজ্জা নেই। উলটে ওঁর দলের লোকেরা, অর্থাৎ নেপু ইত্যাদি বলে কি না, মেয়ে নইলে এত বোকা হয় কখনো, যে চুরি করবে এক জোড়া কানের ফুল, তার আবার একটা দুটো কোথায় পড়ে যাবে! আবার এসেছেন আমাদের ইস্কুলেই মুখ দেখাতে!
অভিনয় যেই-না শুরু হবার সময় কাছে এল, অমনি যে যেখানে ছিল সব হুড়মুড় করে গিয়ে জায়গা দখল করল। যারা জায়গা পেল না, তারা দেয়াল ঘেঁষে সারি সারি দাঁড়িয়ে পড়ল।
সকলের পরনে গরম জামা থেকে কেমন একটা ভিজে কম্বলের মতো গন্ধ বেরুতে লাগল। ভিড় আরও বেশি হত, কিন্তু প্রত্যেক বাড়িতেই দু-এক জনকে থেকে যেতে হয়েছে, পাহারা দেবার জন্যে।
সে যাই হোক গে, বিকেল থেকেই সাজঘরে মহা হইচই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু যেই-না অভিনয় আরম্ভ হবে, আমাদের গানের ওস্তাদ সেতারে একটু টুং-টাং শব্দ তুলেছেন, অমনি সব ফাঁকা হয়ে গেল!
সবাই দৌড়োল রঙ্গমঞ্চের দিকে। উইংসের আড়াল থেকে, এদিক-ওদিক থেকে কেউ স্টেজ দেখছে, কেউ ভিড় দেখছে।
সাজঘরে রইলেন আমাদের বোর্ডিঙের বড়ো মাসিমা। ওঁর অভিনয় দেখবার এতটুকু আগ্রহ নেই। বলেন, কলকাতার বড়ো বড়ো থিয়েটারে কত নামকরা অভিনেত্রীদের দেখে এসেছেন, এখন আবার এসব কী দেখবেন!