সদর দরজাটা হাঁ করে খোলা।
লাবণ্যদি সাহস দিয়ে বললেন, এত ভয়ও পাও তোমরা? আরে, এসব জায়গা তো পুলিশেই একবার দেখে গেছে। ওদের যত কাণ্ড, দরজাটাকে বন্ধ করে দিয়ে যায়নি পর্যন্ত। এখন ঘরে ঘরে বাঘ শেয়ালে আস্তানা গাড়ক।
লতিকাদি সবার পেছন থেকে বললেন, চলো, চলো, এত আস্তে কেন। ঘরের ভেতরেই নাহয় আরাম করে বসে খাওয়া-দাওয়া করা যাবে।
ঢুকে তো পড়লুম। খিদেও পেয়েছিল দারুণ। এঘর ওঘর করে খাবার জন্যে একটা ভালো জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি, কেউ কেউ খিড়কিপুকুরে গেছে হাত-পা ধুতে।
হঠাৎ হাঁউমাউ! এ আবার কী জ্বালা! কে নাকি বারান্দার জমানো ধুলোতে পায়ের ছাপ দেখেছে। এমন ভীতুও হয় মেয়েরা!
লতিকাদি হঠাৎ দোতলায় ওঠবার সিঁড়ির কাছ থেকে সরে এসে বললেন, ওপরে লোক আছে।
আমরা তখুনি যে যাকে পারি জড়িয়ে ধরলুম। লাবণ্যদি বললেন, না, ও-রকম করলে চলবে কেন? চলো, ওপরে গিয়ে দেখে আসি। দেখতেই তো এসেছি।
গেলুম সবাই শেষপর্যন্ত। ওপরটা একটু আবছা মতন, জানলা অনেক বন্ধ রয়েছে। দুটো-একটা যা ভেঙে ঝুলছে, তারি মধ্যে দিয়ে একটু একটু আলো আসছে।
যেখানেই যাই, খালি মনে হয় একটু আগেই সেখানে কেউ ছিল, এখুনি সরে গেছে। যেদিকে তাকাই খালি মনে হয় সেদিক থেকে কেউ আমাদের দেখছিল, এখুনি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
মাঝখানে একটা বড়ো ঘর, দু-পাশে দু-সারি খালি ঘর। তবু মনে হয় কেউ আমাদের আড়ালে রেখে রেখে, নিজে সরে থাকছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা ভয়েই আধমরা, কারো মুখে কথাটি নেই।
হঠাৎ তাদের সঙ্গে একেবারে সামনাসামনি দেখা! নেপু আর তার অপূর্বদা। রাগে আমার গা জ্বলে গেল। অপূর্বদার পেছনে নেপুটা নিজের প্যান্ট আঁকড়ে কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই বলল, এই, সেপটিপিন আছে?
কতকটা তাই শুনে, কতকটা ভয় কেটে যাওয়াতে, মেয়েরা সবাই একসঙ্গে হিহি হোহোহা করে হেসে উঠল। আমার কিন্তু একটু মায়া করতে লাগল। একটা বড়ো সেপটিপিন দিলুম ওকে।
ততক্ষণে অপূর্বদা লাবণ্যদিদিদের সঙ্গে আলাপ পাকিয়ে নিয়েছেন– চালাক তো কম নন– এখন শুনলুম সব একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার কথা হচ্ছে।
শেষ অবধি দুদলে মিলে, সারাদিন ধরে সারা বাড়িটাকে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল, কিছু পাওয়া গেল না। কানের ফুলের কথা ওদের বলতে লাবণ্যদি মানা করে দিয়েছিলেন।
সন্ধ্যে লাগবার আগেই বাড়ি ফেরা হল। বাড়ি এসে শোবার ঘরে ঢুকেই, পকেট থেকে একটা জিনিস বের করে, পড়ার টেবিলের ওপর রেখে নেপু বললে, এই দ্যাখ, তোদের লাবণ্যদিদির কেরামতি দ্যাখ!
তাকিয়েই আমার পিলে চমকে গেল! টেবিলের ওপর আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া সেই লাল-সবুজ পাথর-বসানো কানের ফুলটা জ্বলজ্বল করছে।
নেপুর হাত চেপে ধরে বললুম, বল শিগগির, কোথায় পেলি?
নেপু বললে, কেন, ভূতের বাড়িতে কুড়িয়ে পেয়ে অপূর্বর্দার ব্যাগে রেখেছিলাম। তারপর খেয়েদেয়ে তোমরা যখন হাত ধুতে গেলে, তোমাদের পেয়ারের দিদিমণিটির ব্যাগ সার্চ করতে গিয়ে দেখি, যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই। কখন ওটি অপূর্বদার ব্যাগ থেকে সরিয়ে নিজের থলিতে লুকিয়েছেন। আমি আবার ওটি উদ্ধার করলাম।
আমার হাত কাঁপছিল। চেঁচিয়ে বললুম, নেপু থাম!
বলে আমার থলি থেকে ওইরকম আরেকটা কানের ফুল বের করে সেটার পাশে রাখলুম। টেবিলের ওপর দুটিতে মিটমিট করতে লাগল।
নেপুর মুখটা বোয়াল মাছের মতো হাঁ হয়ে গেছে। অবাক হয়ে থেকে, শেষটা বললে, কোথায় পেলি রে?
বনের মধ্যে কুড়িয়ে পেয়েছিলুম। লাবণ্যদির থলিতে রেখেছিলুম। নিশ্চয় ওটি সরিয়েছিলেন। আমরা হাত ধুয়ে এলে পর, যখন তোরা হাত ধুতে গেলি, তখন অপূর্বর্দার ব্যাগ সার্চ করে আবার ওটি পেলুম। অপূর্বদা নিশ্চয় সরিয়েছিলেন।
খানিকটা চুপ থেকে আবার বললুম, অন্তত তাই তো মনে ভেবেছিলুম। এর মধ্যে কখন যে আবার জগদীশদার পিসিমা এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন তা টের পাইনি! হঠাৎ শুনি, ও মা! কোথায় যাব গো? এত ছোটো কিন্তু এত সাংঘাতিক কে জানত! আমরা বলি খাতায় লেখাচ্ছি। আর বনবাদাড়ে হাতড়ে মরছি, ওদিকে চোর বাছাধনরা ঘরের মধ্যে! ও শ্যামাদাস, ও হরিচরণ, ও বড়োবউমা, মেজোবউমা, কোথা গেলে সব, দেখোসে, কাণ্ড দেখে যাও!
মা জেঠিমা তখুনি দুড়দাড় করে ছুটে এলেন। পিসিমা কানের ফুল দুটোকে তুলে ধরে বার বার বলতে লাগলেন, ওমা, এই-না আমার মানিক-জোড়, এই-না আমার হারানিধি!
তারপর হঠাৎ এক হাতে নেপুর কান চেপে ধরে গর্জন করে উঠলেন, বল হতভাগা, কৌটো কোথায় রেখেছিস? ভালো চাস্ তো বল! উঃ, দেখে মনে হয় গাল টিপলে দুধ বেরুবে, এদিকে ভেতরে ভেতরে কালকেউটে!
কান ধরে ভীষণ এক নাড়া দিয়ে বললেন, দে শিগগির। নইলে আজ তোকে পুঁতেই ফেলব! এসব গয়নাপত্তরের জন্যে আমার পূজনীয় পিতৃদেব নরক ভুগছেন, তা জানিস্। ও কি আমি সহজে ছেড়ে দেব ভেবেছিস নাকি? বের কর বলছি– আঁক!
ইতিমধ্যে জেঠিমা হঠাৎ ছুটে এসে পিসিমার পিঠে বিরাশি ওজনের এক কিল বসাতেই, যেই না পিসিমা চমকে গিয়ে নেপুর কান ছেড়ে দিয়েছেন, অমনি নিমেষের মধ্যে সে তো হাওয়া!
আমি মাঝখানে পড়ে বার বার বলতে লাগলুম, ও জেঠিমা, ও পিসিমা, আমার কথা শোনোই-না, নেপু ওগুলো নেয়নি, আমরা কুড়িয়ে পেয়েছি!