সমস্ত জঙ্গল কাঁপিয়ে একটা বিকট গমমম্ করে আওয়াজ হল।
লাবণ্যদির পর্যন্ত মুখ সাদা হয়ে গেল। কিন্তু কী সাহস তার! আমাদের বললেন, মেয়েরা, তোমরা আমার পেছন পেছন এসো। এ হয় বাঘ, নয় বন্দুক!
আমরা তখুনি লাইন বেঁধে, এর কাঁধে ও হাত রেখে এক জনের পেছন এক জন এগুতে লাগলাম। লতিকাদি সবার শেষে।
আবার গমগমমম করে আওয়াজ হল। লতিকাদি এক লাফে লাইনের শেষ থেকে মাঝখানে এসে ঢুকলেন। বললেন, শুনেছি সবার শেষেরটাকে সর্বদা বাঘ নেয়। আমায় নিলে, কে তোমাদের রক্ষা করবে?
মেয়েরা তখুনি ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় আমার চোখে পড়ল ঝোঁপের মধ্যে রামছাগলের পশ্চাদ্ভাগ।
ডালপালাতে শিং আটকে গেছে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়েও কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না, তাই হম্ম গমম্ করে ডাক ছাড়ছে!
মহা মুশকিল! কেউ ছাগলের কাছে যেতে চায় না। তখন লাবণ্যদি নিজের থলি থেকে মস্ত কলা বের করে, ছাগলের সামনে একটু তফাতে মাটির ওপর রাখলেন!
তাই দেখে রামছাগল এমনি জোরে এক ঝাঁপ দিল যে নিমেষের মধ্যে শিং ছেড়ে কলা সাবাড়! কী অদ্ভুত বুদ্ধি লাবণ্যদির!
আর একটু এগিয়েই দেখা গেল পথের মাঝখানে একটা পেন্টেলুনের বোতাম পড়ে। লতিকাদি বললেন, পুলিশদের বোতাম। তারা এর বেশি আর এগোয়নি।
লাবণ্যদি বললেন, নাও, ওটাকে যত্ন করে তুলে রাখো, একটু আগেই পড়েছে, পরিষ্কার ঝকঝক করছে, একটু শিশির পর্যন্ত লেগে নেই। তাই তো! বোতামটাকে তুলে যত্ন করে আমার থলিতে রাখলুম। বড়ো গোয়েন্দারা কখনো ছটো জিনিসকে অবহেলা করেন না।
তবে এও সত্যি যে আমার বুকটা একটু ঢিপঢিপ করছিল। আর আমাদের ক্লাসের মঞ্জির কথা আর কী বলব! ন্যাকার একশেষ! তার ওপর ওরা ভারি বড়োলোক, নিজেদের মোটর চেপে ইস্কুলে আসে বলে অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না!
কত ঢঙ। রোজ নতুন নতুন শাড়ি পরা চাই, কানের গয়না বদলানো চাই, জুতোই আছে চার পাঁচ জোড়া!
আবার নিজে সঙ্গে করে টিফিন আনে না, ঠান্ডা খাবার খেতে নাকি ওর গা ঘিন্ ঘিন্ করে– কথাটা কাঁদের ঠেস দিয়ে বলা হত সে আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকত না–ওর জন্যে রোজ একটা কোটপরা চাকর টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে লুচি, চপ, সন্দেশ– এইসব নিয়ে আসে, আর ও আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে খায়! ঠিক হয়েছে! আজ জাদুকে নিজের খাবার নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে, হাতে ডান্ডা নিয়ে, আমাদের সঙ্গে আসতে হয়েছে। তবু কিন্তু ন্যাকামির শেষ নেই!
উঃ! লতিকাদি! কী একটা আমার পায়ের ওপর দিয়ে সড়সড় করে চলে গেল যে!
আমি বললুম, ও কিছু না। সাপটাপ হবে-বা।
আর যায় কোথা!
ওঁ বাবা। ওঁ লাবণ্য দি!
বলে এক লাফে লাবণ্যদির পাশে। সেখানে আবার মাটিতে পা পড়বামাত্র ওরে বাবারে বলে সে কী চেল্লানি!
কী জ্বালা! কী হল কী, তাই বল না!
বলবে কী! ঠ্যাং চেপে মাটিতে বসে পড়েছে। আমরা অবাক হয়ে দেখি পা দিয়ে রক্তের গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। আর পায়ের ঠিক সেই জায়গাটার মাঝখানে একটা শিরার ওপর বিধে রয়েছে লাল-সবুজ পাথর-বসানো একটা সোনার পিন!
আমাদের কারো মুখে কথা নেই! ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলুম।
লাবণ্যদি কিন্তু তখুনি ওর পা থেকে পিনটা টেনে বের করে ফেলে, জায়গাটাকে বোতলের জল দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে, আইডিন লাগিয়ে, নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে ফেলেছেন।
অথচ তার কিছু দরকার ছিল না। আমাকে বললে, আমার সঙ্গে ব্যান্ডেজ ছিল, বেশ বেঁধে দিতে পারতুম।
আর মঞ্জির সে কী ঢঙ!
ও লাবণ্যদি, আপনি আমার পায়ে হাত দিলেন! দিন দিন আপনার পায়ের ধুলো দিন, নইলে আমার পাপ হবে!
ছোঃ! সাধে কি নেপুটা মেয়েদের ঘেন্না করে!
০৪.
যাই হোক, মঞ্জির পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধার পর আমরা সবাই লাবণ্যদিকে ঘিরে পিনটা দেখতে লাগলুম।
মোটেই পিন নয়, স্ক্রু-আঁটা একটা কানের ফুল; লাল-সবুজ পাথর থেকে আলো ঠিকরোচ্ছে।
আমরা বলতে লাগলুম, ইস্, এ-রকম তো কখনো চোখে দেখিনি! অমনি মঞ্জিটা বলে উঠল, ও আর এমন কী! আমার ঠাকুমার অমন মেলা আছে। তা ছাড়া হার আছে, বাজু আছে, রতনচূড় আছে, কানবালা আছে, বাউটি আছে–।
লাবণ্যদি কিছু না বললেও, লতিকাদি শেষটা বাধা দিয়ে বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা ঢের হয়েছে, তোমাদের বড়োমানষির আর ফিরিস্তি দিতে হবে না!
আমিও আর থাকতে না পেরে বললুম, আমাদের বুড়ি ঝির-ও ও-রকম অনেক আছে।
অমনি লতিকাদি ধমক দিয়ে বললেন, তুমিও এবার থামো দিকিনি।
এতদিন পরে তবু চোরাই মালের একটা চিহ্ন পাওয়া গেল। আর একটা যখন পাওয়া গেল, বাকি বেরুতে কতক্ষণ! এসব ব্যাটাছেলেদের কম্ম নয়। আমার বাবাকে তো রোজ পাঞ্জাবির বোতাম খুঁজে দিতে হয়। অথচ তবু নেপুটার কী চাল!
সবাই বলতে লাগল, তা হলে অন্য জিনিসগুলোও কাছেই কোথাও লুকোনো আছে! এটা কী করে অসাবধানে পড়ে গেছে। ওই তো সামনে ভূতের বাড়ি, ওখানে থাকাও কিছুই আশ্চর্য নয়।
বিরাট বাড়ি। আশেপাশে বিশাল বিশাল শিশু গাছ। তাদের ঝোলানো পাতার ভেতর দিয়ে বাতাস বইছে– আর শিরশির করে শব্দ তুলছে। এখানে এত ঘন বন যে গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে ভালো করে আলো আসে না, চারদিকটা সবুজ সবুজ, ভিজে ভিজে, গা ছমছম করে।
বাড়িটাও প্রকাণ্ড, সারি সারি জানলার বেশির ভাগ ভেঙে ঝুলছে। দেওয়ালে পুরু হয়ে শ্যাওলা জমে গেছে, ফাটলে ফোকরে বেশ বড়ো বড়ো বট অশ্বত্থ গাছ গজিয়ে গেছে।