জেঠিমা বললেন, তা ভজহরি এসেছিল কেন?
না, ইয়ে কী বলে, ওই পিন্টোর মেম একটু রাগী প্রকৃতির কি না, তাই সার্চ করতে যারা যারা গেছল, তাদের সবাইকে আইডিন লাগাতে হচ্ছে। কিন্তু ভজহরিরা তো অ্যালোপ্যাথিক লাগাবে না, তাই আমার কাছে এসেছিল আর্নিকা নিতে।
জেঠিমা নাক অবধি লেপ টেনে বললেন, শখও আছে বাবা! এই শীতে আর্নিকার খোঁজ কচ্ছে!
জ্যাঠাইমশাই জুতো ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তোমার বাপের বাড়ির কেউ তো আর হোমিয়োপ্যাথির মর্ম বুঝল না, তাই ওইরকম বল। তবে এও আমি বলে রাখলাম, যদি ঠিক ঠিক ওষুধটি পড়ে, একেবারে ধন্বন্তরি!
এইরকম আরও কী কী সব কথাবার্তা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
কাল ছুটি। লাবণ্যদি লতিকাদি আমাদের দলের সাতজন খুব সাহসী মেয়ে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে বেড়াতে যাবেন, একেবারে ভূতের বাড়ি অবধি দেখে আসবেন।
সকাল থেকে সবার মুখে পিন্টো সাহেবের পেজোমি ছাড়া আর অন্য কথা নেই। নেপুর সবটাতেই কিছু বলা চাই, এঘরে এসে বলল, আরে, শুধু পিন্টো কেন, অনেক ওস্তাদের বাড়ি সার্চ করলেই অনেক কিছু বেরুবে।
বলে এমন বিশ্রী করে হাসতে লাগল যে আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে লাবণ্যদিদিদের কথা বলছে।
তবু ওকে কিছু না বলে, মাকে বলে শংকরকে নিয়ে লাবণ্যদির বাড়ি চলে গেলুম।
কী সুন্দর বাড়ি লাবণ্যদির আর রেখেছেন কী চমৎকার করে সাজিয়ে! দরজা জানলায় গোলাপি পরদা, সিঁড়ির দু-পাশে ছোটো ছোটো টবে কত ফুল! সদর দরজা খোলা, ভেতরে বড়ো বড়ো দুটো পেতলের ফুলদানি চকচক করছে।
আর লাবণ্যদি নিজেও যে কী সুন্দর দেখতে, সে আর কী বলব। মাথায় কত লম্বা, রংটা খুব ফর্সা না হলেও কেমন মোলায়েম, আর একমাথা কালো কোঁকড়া চুল। নীল একটা শাড়ি পরেছেন, কোমরে দিব্যি করে আঁচলটা জড়িয়েছেন।
আমাকে দেখেই বললেন, বাঃ, এসে পড়েছ, ভালোই হল! সেখানেই খাওয়া-দাওয়া হবে বলে এসেছ তো?
শংকরদা অমনি সর্দারি করে বলে উঠল, দিদিমণি কিন্তু মোটে ঝাল খায় না মা। ঝাল খেলেই দিদিমণির পেট
এমন রাগ হল, খুব কষে ধমক দিলুম, বললুম, আচ্ছা, আচ্ছা, তোকে আর এর মধ্যে নাক গলাতে হবে না। তোর এখানে আর থাকবার দরকার নেই, তুই বাড়ি যা।
কিন্তু সে কিছুতেই যেতে চায় না, মা নাকি সঙ্গে যেতে বলে দিয়েছেন। কী মুশকিল! আমাদের সঙ্গে বাইরের লোক গেলেই-বা চলবে কী করে? দেখলুম লাবণ্যদিদির কী বুদ্ধি! চট করে বললেন, তুমিও যাচ্ছ, ভালোই হল। আচ্ছা বেশ, তাহলে আমাদের দশ জনের খাবারের টিন আর জলের বোতলগুলো তুমিই বয়ে নিয়ে চলো।
তাই শুনে শংকরের সব উৎসাহ উড়ে গেল। সে বললে, না দিদি, আমার আবার পায়ে গুপো, অত পারবনি। তা ছাড়া আপনারাই যখন রইছেন, আমার আবার যাবার দরকারটা কী? বাড়িতে মেলা কাজও জমে রয়েছে।
কথা শেষ হবার আগেই শংকর রওনা দিল। লাবণ্যদিও খুশি হয়ে বললেন, দেখলে তো? ও ধমকধামকে কিছু লাভ হয় না, প্যাঁচ কষতে হয়।
তারপর আর কী! সবাই খেলার মাঠ পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।
যেই-না ঢুকলাম অমনি চারদিক ছায়া-ছায়া ঠান্ডা-ঠান্ডা হয়ে গেল। নাকে কেমন একটা বুনো গাছপালার সোঁদা গন্ধ আসতে লাগল। অন্য আওয়াজ-টাওয়াজ সব কোথায় মিলিয়ে গেল, কানে আসতে লাগল শুধু বনের নিজের হাজাররকম সরসর, খসখস, মটমট, ঝিরঝির, ঝরঝর শব্দ।
কারো মুখে বেশি কথা নেই। প্রত্যেকেরই কাঁধে ঝোলানো একটা থলি, তাতে খাবার-দাবার, জলের বোতল, আইডিন, এই সব। সঙ্গে লতিকাদি, দেখতে লাবণ্যদির মতো সুন্দর না হলেও, দারুণ গায়ে জোর। শুনেছি একদিন রাতে ওঁর ঘরে চোর ঢুকেছিল, তাকে ছাতা দিয়ে এমনি পিটেছিলেন যে, চুরি তো সে করতে পারেইনি, উপরন্তু অন্য জায়গা থেকে আনা মেলা জিনিসপত্র ফেলে কোনোমতে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল।
লতিকাদি আজ আবার সেই গল্প আমাদের বলে বললেন, ভাগ্যিস পালিয়েছিল ব্যাটা! নইলে সেদিন যা রেগে গেছলাম, একটা এসপার-ওসপার না করে ছাড়তাম না। সম্ভবত ওসপার। মেয়েরা, তোমরাও ওইরকম করবে। এখন নাও তো, প্রত্যেকে শক্ত দেখে একটা করে গাছের ডাল ভেঙে নাও তো। দেখাই যাক না, চোরদেরই একদিন, কী আমাদেরই একদিন।
তাই-না শুনে আমরাও আশেপাশের গাছ থেকে একটা করে নীচু ডাল ভেঙে নিয়ে, পাতাটাতা ছাড়িয়ে দিব্যি লগুড় বানিয়ে নিয়ে চললুম। ভাগ্যিস গুপেটা কাছে ছিল না, নইলে এই নিয়েই আবার কী না জানি বলত! হাড়গোড় ছড়ানো জায়গাটাও দেখলুম। ও বের করাতে অপূর্বার কোনো বাহাদুরি ছিল না, একেবারে পথের ওপর। কথাটা লাবণ্যদিকে না বলে পারলুম না।
জানেন লাবণ্যদি, ছেলেদের ইস্কুলের অপূর্বদা এই মুরগির হাড় দেখে কী যে কাণ্ড লাগিয়েছেন, সে আর কী বলব!
লাবণ্যদি ভুরু তুলে বললেন, অপূর্বদাটি কোন জন?
বললুম, ওই যে গুণ্ডা চেহারার গুঁফো লোকটা।
তাই শুনে মুখে রুমাল দিয়ে, লাবণ্যদি খুব খানিকটা হেসে নিলেন। সবসময় এত ভালো ব্যবহার করেন। আমরা আর রুমাল কোথায় পাই, মুখের ওপর হাত দিয়েই খুব হাসলাম।
হঠাৎ লতিকাদি ঠোঁটে আঙুল চেপে বললেন, শ—শ–শ! সাবধান! এই পথে খানিক আগেই অনেক লোক হেঁটে গেছে। ওই দেখো ঘাস মাড়ানো, এখন পর্যন্ত সব শুয়ে শুয়ে রয়েছে, খাড়া হবারও সময় পায়নি। ও বাবা! ওটা কী!