আর বলতে হল না। পিসিমা বিষম রেগে চেঁচিয়ে উঠলেন, চোপ, ইডিয়েট! হাটের মাঝে হাঁড়ি কি না ভাঙলেই নয়!
গুটেটা একেবারে পিসিমার ঘাড়ের কাছে এসে, হাঁ করে সব কথা শুনছিল। পিসিমা বিরক্ত হয়ে নাকে কাপড় দিয়ে বললেন, কাঁচা পেঁয়াজ গিলে এসে আমার নাকের কাছে কি নিশ্বাস না ফেললেই নয়, বাছা?
গুটে একটু সরে দাঁড়িয়ে জগদীশদাকে বললে, দেখুন জগদীশবাবু, আমাকে সবকথা খুলে না বললে কিন্তু চলবে না। তা না হলে আমি তদন্ত করব কী করে?
জগদীশদা বললে, আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবে খন। তুমি এখন এসো তো।
গুটে কিছুতেই নড়বে না, বলে, আর দেখুন, নাহয় চাকরির খাতিরে চাকর সেজেই রয়েছি। তাই বলে আপনার পিসিমার কি উচিত হয় আমার সঙ্গে সত্যিকার চাকরের মতো ব্যবহার করাটা? দেখুন, একবার আমার হাতের দশাটা দেখুন। সেই যে সকাল থেকে আমার পেছনে লেগেছেন, এক মিনিটের জন্যে বিরাম নেই! এমন করলে কী করে পারি তাই বলুন?
জগদীশদা পিসিমাকে বললে, আচ্ছা পিসিমা, সব জান, তবু এ-রকম কেন কর বলে দিকিনি! চোর ধরতে পারলে সরকার থেকে পাঁচশো টাকা পুরস্কার পাওয়া যাবে তা জান? তোমার হরিদ্বার যাবার খরচটা উঠে যাবে।
পিসিমা কিছুতেই বোঝেন না। না বাপু। আমি যাই হরিদ্বারে, আর তোমার গুটে গুণধর বাকি গয়নাগুলো–। জগদীশদা ছুটে গিয়ে মুখ চেপে ধরল।
গুটে আরেকটু এগিয়ে এল।
কী কী গয়না, মাঠাকরুন? কোথায় রেখেছেন সেগুলো? আহা, কিছুই যদি না বলেন তো সেসব রক্ষে করব কী করে?
বাকিরা এতক্ষণ হাঁ করে সব শুনছিলেন। পিসিমা কোনো জবাব দিচ্ছেন না দেখে, একটু রাগ করে জেঠিমা বললেন, চলো তোমরা, এখানে আর নয়। দেখছ না, আমরা আছি বলে এঁদের কথাবার্তার অসুবিধে হচ্ছে। তা দিদি, তোমাদের ওইসব জুয়োখলার জিনিসের ওপর আমাদের কোনো লাভ নেই। আমার বাবা আমাকে আশি ভরি সোনার গয়না দিয়েছিল, সেই আমার যথেষ্ট। আমি মলে অদ্দেক পাবে মণির বউ আর অদ্দেক পাবে নেপুর বউ। তা সেসব এমনি লুকিয়ে রেখেছি যে আমি নিজে বের করে না দিলে, চোররা কেন, এরাও তার সন্ধান পাবে না। হ্যাঁ।
এই বলে জেঠিমা আমাদের একরকম টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে এলেন। আমার একটুও আসতে ইচ্ছে করছিল না। চোর ধরতে হলে কথায় কথায় রেগে অকুস্থল ছেড়ে চলে যাওয়াটাও কিছু কাজের কথা নয়।
বাড়ি এসে দেখি নেপুটা ভারি লাফাচ্ছে!
পুলিশের লোকেরা কিছু পায়নি, অথচ আমাদের অপূর্বদা কত হাড়গোড় সংগ্রহ করেছেন!
শুনে বেজায় হাসি পেল। তাও যদি নরকঙ্কাল হত! মুখে শুধু বললুম, রেখে দে তোদের অপূর্বদার আস্ফালন! কে ওখানে পিকনিক করেছে, তাই দেখে কর্তা নেচে-কুঁদে একাকার!
নেপু চটে লাল।
কেউ পিকনিক করে না ওই বনের মধ্যে। এটা তুই ভালো করেই জানিস। সবাই জানে ওখানে ভূতের ভয়। বাইরের লোক না হলে ওখানে কেউ খাওয়া-দাওয়া করবে না, এটা তুইও বেশ জানিস। ওসব তোর হিংসের কথা। তোদের লাবণ্যদিদির দিনই কাবার হয়ে যায় চোখে কাজল লাগাতে আর কপালে টিপ পরতে, ও আবার চোর ধরবে! জানিস, কাল সকালে পুলিশের সাহায্যে ওই বন গোরুখোজা করা হবে। সরু চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানো হবে। ভূতের বাড়িটা পর্যন্ত একেবারে চষে ফেলা হবে!
বুকটা ধড়াস করে উঠল। কাল সকালে লাবণ্যদিদিদের সঙ্গে আমাদের ইস্কুলের দলও যে চোর। খুঁজতে বনে যাবে!
০৩.
ওই পাহাড়ে দেশের সে দারুণ শীতের কথা আর কী বলব! একেবারে হাড়ের ভেতরে ঢুকে যেত। রাত্রে শুতে যাওয়াই ছিল এক ব্যাপার! ঠান্ডার চোটে বালিশ বিছানা মনে হত ভিজে সপসপে। একটা গরম জলের ব্যাগ দিয়ে বিছানা গরম করে নিয়ে তবে-না শোয়া যেত। আর সকালে ওঠা? সে যে আরও কষ্ট। লেপের ভেতর থেকেই গরম জামা এঁটে, গরম মোজা পায়ে দিয়ে উঠতে হত।
ওদিকে সন্ধ্যে সাতটা না হতেই যেন দুপুর রাত! পথে-ঘাটে জনমানুষ নেই। আমাদের বাড়িতে ইলেকট্রিক আলো ছিল না। আমরা ছেলেপুলেরা এক ঘরে শুতাম আর তারি পাশের ঘরে জেঠিমারা শুতেন। মাঝখানকার দরজা খোলা থাকত, সেখানে টিমটিম করে একটা লণ্ঠন জ্বলত।
মাঝে মাঝে ভালো ঘুম হত না। জল তেষ্টা পেত। কিন্তু উঠতে যত-না শীত করত, তার চেয়ে বেশি ভয় করত।
অথচ নেপুর কাছে কিছু বলবার জো ছিল না, অমনি পরদিন তাই নিয়ে সব বাড়িয়ে বাড়িয়ে পাঁচরকম কথা বলবে। শেষে লাবণ্যদি লতিকাদিদের অবধি টেনে আনবে। কী দরকার বাবা।
সেদিন অনেক রাতে ঘুম ভাঙতেই দেখি ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। আমার তো গায়ের রক্ত হিম। কান খাড়া করে থাকতাম। ওদিকে গলা শুকিয়ে তক্তা, জেঠিমাকে ডাকি কী করে?
তার ওপর মনে হল কারা যেন কাছেই কোথাও ফিসফিস করে কথা বলছে; কে যেন দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল, খস করে সরে গেল। কারা যেন বাড়ির আশেপাশে পা টিপে টিপে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আর একটু হলে ভয়ের চোটে মরেই গিয়েছিলুম আর কী, এমন সময়ে ওধারের দরজা খুলে, লণ্ঠন হাতে জ্যাঠামশাই এসে ওঘরে ঢুকলেন।
জেঠিমা বললেন, ধরলে নাকি?
জ্যাঠামশাই যেন বিরক্ত হয়ে উঠলেন।
এ কি ক্রিকেট বল নাকি যে ধরব? না না, ওসব তোমার মিছে ভয়। ভজহরি এসেছিল, বললে আমাদের আপিসের পিন্টো সাহেবের বাড়িতে সার্চ হয়েছে। এদানীং যেসব জিনিস চুরি গেছে তার কোনোটাই পায়নি বটে, কিন্তু গত কুড়ি বছরের মধ্যে আমাদের আপিসের যা কিছু হারিয়েছে সব নাকি বেরিয়েছে।