তখন মা জেঠিমাদের কাজ সারা হয়ে যেত, সবাই হাতমুখ ধুয়ে চুল-টুল বেঁধে, একটা করে নীল আলোয়ান জড়িয়ে, জেঠিমার শোবার ঘরের তক্তপোশের ওপর গোল হয়ে বসতেন। আজকাল বড্ড শীত পড়ে গেছে, বাগানে আর বসা চলে না।
কতরকম জল্পনাকল্পনাই-না চলত ওঁদের। কোথায় কবে কী চুরি-ডাকাতি হয়েছিল তার গল্প শুনে শুনে আমাদের গা শিরশির করত। আবার মাঝে মাঝে বাইরে একটা পাতা খসার শব্দ শুনেই চমকে চমকে উঠতেন সবাই। ও দিদি! ও আবার কেমনধারা আওয়াজ!
জেঠিমার তো অন্ধকার হলে পর জানালার কাচ দিয়ে বাইরে তাকাতেই ভয় করে, উনি আবার চোর ধরবেন! অথচ বয়সে বড়ো বলে উনিই হলেন ক্যাপ্টেন! মাকে ডেকে বলতেন, মেজোবউ, যা, দেখে আয় কীসের শব্দ।
আমার মা বন্ধ জানালার পরদাটা আঙুল দিয়ে একটু সরিয়ে টুক্ করে এক বার দেখেই বলতেন, কই, কিছু না তো! পাতা খসার আওয়াজ হবে হয়তো।
একদিন ওইরকম জানালার কাছ থেকে ফিরে এসেই জগদীশদার পিসিমাকে বলে বসলেন, তুমি তো দিদি, সব জানো। তবে কেন পুলিশের কাছে কথাটা খুলে বলছ না? ওই যার কাছ থেকে তোমার বাবা জুয়ো খেলে সোনার কৌটো জিতেছিলেন, তুমিই তো বলেছ যে সেই লোকটা প্রতিজ্ঞা করেছে নাতনির বিয়েতে ওই কৌটো দেবেই দেবে। তবে কেন তাকে ধরিয়ে দিচ্ছ না?
মার কথা শুনে বাকি সবাই কাঠ! পিসিমা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আরে, কী যে বলিস পাগলের মতো! সে কি আর আছে যে ধরিয়ে দেব? কোন্ কালে মরে সগগে গেছে। পৃথিবীর নিয়মই হল হাড় পাজিরা বেশিদিন কষ্ট ভোগ করে না।
তাই শুনে আমার মা বললেন, আহা, তাকে না পাও, তার ছেলেকে তো জেলে দিতে পারো। সে-সুষ্ঠু তো আর মরে যায়নি!
পিসিমা বললেন, গেছে রে গেছে। পাজির গুষ্টি, সব কটা সগগে গেছে। এক আছে ওই নাতি-নাতনি গুটি কতক! সব কটা নাকি সমান দুষ্টু!
জেঠিমা বললেন, সে কী! তাদের তুমি চেন নাকি?
চেনবার কিছু দরকার করে না। ও-বংশের কেউ ভালো হতে পারে না, তাই বলছি। আরে বাবা বেচারি নাহয় একটু জোচ্চুরিই করেছিলেন, তাতে কী আর এমন হয়েছেটা তাই তোরা বল? কত লোকে তো অমন করে! অথচ সে-বুড়ো হতভাগা এমনি করতে লাগল যেন বাবা বেচারি কী অন্যায়টাই-না করেছেন! শেষপর্যন্ত বেচারাকে কলকাতা ছেড়ে, নাম ভাঁড়িয়ে, এখানে এসে শেষবয়সে ভগবানের নাম করে দিন কাটাতে হয়েছিল!
মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, তা ওইসব নাতি-নাতনিদের–তাহলে হাজতে পোরা হচ্ছে না কেন?
পিসিমা রেগেমেগে এবার উঠেই পড়লেন।
কী জ্বালা, তুই তো ভারি বোকা দেখতে পাচ্ছি! পুলিশকে কৌটো হারানোর কথা বলি আর কী! তারপর বাবার জোচ্চুরির কথাটাও ফাঁস হয়ে যাক, তাতে ভালোটা কী হবে শুনি? তবেই আর কৌটো পাওয়া গেছে। তা ছাড়া তাদের ঠিকানাও জানি নে।
পিসিমা এবার সত্যি বাড়ি যাবার জন্যে আলোয়ানটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলেন। যেতে যেতে আবার চাপা গলায় বললেন, জগদীশ একটা নতুন চাকর রেখেছে।
মা-জেঠিমারা আঁতকে উঠে বললেন, না, না, দিদি, আজকাল চারিদিকে যে কাণ্ড হচ্ছে, এ-সময় অচেনা লোক না রাখাই ভালো।
পিসিমা হেসে বললেন, তোদের যেমন বুদ্ধি! আরে, আসলে ও হল গিয়ে একটা পাকা গোয়েন্দা। টিকটিকি গো। চাকর সেজে তদন্ত করছে। কই, শঙ্করা আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসুক তাহলে।
পরদিন টিকটিকিটাকে নিজের চোখে দেখলাম পর্যন্ত। জগদীশদাদের বসবার ঘরের জানলায় পরদা টাঙাচ্ছে।
কী চালাক দেখতে সে আর কী বলব! কে বলবে গোয়েন্দা, স্রেফ একটা চোরের মতো দেখতে! খুদে খুদে করে চুল ছাঁটা, থ্যাবড়া নাক, ছোট্ট ছোট্ট চোখ নাক ঘেঁষে রয়েছে, পাশ দিয়ে তাকায়, কুচকুচে কালো গায়ের রং আর এই এই হাতের পায়ের গুলি! আবার পরেছে হাতকাটা গেঞ্জি আর কালো হাফপ্যান্ট।
পিসিমা দেখলুম লোকটার ওপর হাড়ে চটা। মাকে বললেন, বকরাক্ষসের সঙ্গে ব্যাটার কোনো তফাত নেই। সারাদিন খালি খাই খাই। কোনো কিছু তুলে রাখবার জো নেই! কী জানি বাবা, সারাক্ষণ যদি গিলবেই তো চোর ধরবে কখন?
লোকটা দেখলুম ততক্ষণে পরদা টাঙানো শেষ করে, রান্নাঘরের সিঁড়ির ওপর বসে এই বড়ো এক ঠোঙা মুড়ি, কাঁচালঙ্কা আর কঁচাপেঁয়াজ দিয়ে মেখে বেশ একমনে খাচ্ছে। এমন সময় জগদীশদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল, গুটে কোথায়? এই ব্যাটা, তুই এখানে বসে মুড়ি গিলছিস আর মাইনে খাচ্ছিস, ওদিকে অপূর্ববাবুরা তো সব বের করে ফেলল!
গুটে মুখে আরেক মুঠো মুড়ি পুরে বলল, কী যে বলেন! চোর ধরবে ওই স্টুপিডটা? ধরে যদি এই শম্মাই ধরবে, কিন্তু একটু না খেলে খাটব কী করে?
ততক্ষণে পিসিমা-জেঠিমারা জগদীশদাকে ঘিরে ফেলেছেন।
কী সর্বনাশ! ওমা, অপূর্বটারও পেটে এত বুদ্ধি! বাইরে দেখতে ওই ভালোমানুষ! তা ক-টাকে ধরল? তাদের সব ফাঁসি হবে বোধ হয়?
জগদীশদা রেগে উঠল।
চুরির জন্যে ফাঁসি হয় কখনো! যা বুদ্ধি তোমাদের? চোর ধরা অত সহজ নাকি?
হয়েছে এই যে অপূর্বরা খেলার মাঠের ওপারের জঙ্গলে গিয়ে দেখে চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে শুধু হাড় আর চিবোনো মুণ্ডু কী হল, অমন হাঁ হয়ে গেলে কেন? ব্যাটারা সেখেনে গিয়ে মহা ফিস্টি দিয়েছে, মেলা মুরগি বেঁধে খেয়েছে। সম্ভবত সব চুরি করা। চারদিকে শুধু হাড় আর লুচির ঝোড়া আর রসগোল্লার হাঁড়ি। কীরকম সাহস বেড়ে গেছে ভেবে দেখো! বলতে গেলে একেবারে আমাদের দোর গোড়ায় বসে ভোজ মেরেছে আর ফন্দি এঁটেছে! এবার কী হয় কে জানে! আচ্ছা, পিসিমা, তুমি কি সেই সব।