সে যাক গে, এইভাবে বেশ দু-তিনটে মাস কেটে গেল, একটা জিনিস বা একটা লোক ধরা পড়ল না।
০২.
বলেছি তো আমাদের শহরটা ছিল পাহাড়ে, দারুণ শীত পড়ত সেখানে। রাতে লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে শুনতুম বাড়ির পেছনে, ছোটো নদীর ওপারে, সরকারি জঙ্গলের মধ্যে শীত লেগে হুতুমপ্যাঁচা ডাকছে। দূরে দূরে থেকে থেকে ক্যা-হুঁয়া ক্যা-হুঁয়া বলে শেয়াল চাঁচাত। বাড়ির টিনের ছাদ সারাদিন রোদে তেতে, রাতের ঠান্ডায় মটমট করত।
কিন্তু এসব শব্দের চেয়েও স্পষ্ট শুনতে পেতুম কারা যেন বাড়ির বাইরে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
একদিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর, ছুটে বেরিয়ে গিয়ে এক ব্যাটার গলা টিপে ধরেও ছিলেন। সে কিন্তু মহা কাও ম্যাও লাগাল, সে নাকি বাবার বন্ধু গোপেনবাবুর নতুন চাকর, কী চিঠি নিয়ে এসেছে। বেরও করে দিল একটা চিঠি, শেষপর্যন্ত তাকে ছেড়ে দিতে হল।
সত্যিকার চোর আর কেউ চোখেও দেখল না। অথচ কমিশনার সাহেবের বাগানের সমস্ত আলু গাছ রাতারাতি কে উপড়ে নিয়ে চলে গেল। তাতে আলু কত! এক-একটা গাছেই কুড়ি-বাইশটা করে। এরজন্য থানার ইশ্চার্জ কোন অজ পাড়াগাঁয়ে বদলি হয়ে গেলেন, কিন্তু চোর ধরা পড়ল না।
তাঁর বদলে যিনি এলেন, তিনি এসেই শহরে নতুন যারা আসছে আর পুরোনো যারা বেরিয়ে যাচ্ছে, সবাকার নাম ধাম পেশা টুকে রাখলেন।
প্রতি বছর এই সময় শীতের মুখে, জগদীশদার পিসিমার গুরুদেব এসে দশ-বারো দিন লুচি-পাঁঠা-ক্ষীরসর খেয়ে মোটা হয়ে, দু-খানি নতুন কম্বল নিয়ে চলে যান। এ-বছর যেই-না টিকিসুদ্ধ দেখা দিয়েছেন, অমনি কাঁক করে পুলিশরা ধরেছে তাকে।
আমাদের ক্লাসের সবচাইতে ভালো মেয়ে পুঁটি, জগদীশদাদের পাশের বাড়িতে থাকে। সে বললে গুরুদেবকে ধরাতে পিসিমার সে কী রাগ!
আমার অমন সোনার ডিবে গেল, বলে তারই শোকে মলাম! আবার কি না শ্রীভগবানকে ফাটকে দিয়েছে! এমন দেশে চুরি হবে না তো হবে কোথায় শুনি! দেখো, কেউ ধরা পড়বে না, কিছু পাওয়া যাবে না, আমার সোনার ডিবেও না। হাউ হাউ।
যখন সত্যি সত্যি বেশ কিছুদিন কেটে গেল, তখন একদিন কমিশনার সাহেবের বাড়িতে সকলের নেমন্তন্ন হল। বাগানের মধ্যিখানের খোলা জায়গাটিতে ছেঁড়া শতরঞ্জি পেতে বসিয়ে, চা আর আলুভাজা খাইয়ে দেওয়া হল। তারপর সকলে মিলে ঠিক করা হল যে এ আর একা পুলিশের কম্ম নয়, শহরসুদ্ধ সবাইকে কাজে নেমে যেতে হবে।
মিটিং করতে করতে সন্ধ্যে হয়ে এল, দাঁড়কাকরা গাছে ফিরে এল, সুয্যি ডোবার সঙ্গেসঙ্গে অন্ধকার নেমে এল।
বাড়ি ফেরবার পথে বাবা শশীবাবুর দোকান থেকে একটা লম্বা খাতা কিনে, ঘরে ঢুকেই আমার নতুন সবুজ কলমটা চেয়ে নিয়ে, চোর ধরবার লোকজনদের নাম লিখতে বসে গেলেন। কলমটা দিয়ে আবার গলগল করে কালি বেরুত, সেসব নতুন খাতায় মেখেটেখে একাকার, বাবা তো রেগে কাই!
শেষটা পেনসিল দিয়ে লিখতে হল। নেপু আর আমি স্কুলে নাম দেব বলে আমরা ছাড়া আর সকলের নাম ১নং ২নং করে লেখা হল।
আমাদের শংকর ঠাকুর নাম লিখিয়ে সটান নিজের ঘরে গিয়ে বাক্স-প্যাটরা বাঁধতে লেগে গেল। বলে, আজ নাম লিগিলু কাল ধরি নিলু! আধ ঘণ্টা ধরে মা আর জেঠিমা ওকে বোঝাতে লাগলেন। পরে অবিশ্যি খুশি হয়ে মাছকাটা বঁটি নিয়ে শুল।
পরদিন নেপু ইস্কুল থেকে ফিরেই বলল, অপূর্বারা প্রমাণ পেয়েছেন এসব কোনো মেয়ের কাজ, তোদের মাস্টারনিদের সাবধান হতে বলিস।
আমিই-বা ছেড়ে দেব কেন, একটা মানসম্মান আছে তো? কাজেই বললুম, যার বিশে ডাকাতের মতো চেহারা তাকে অত কথা বলতে বারণ করিস।
নেপু রাগে ফুলতে ফুলতে বলল, তোদের লাবণ্যদিদিকে ওয়ার্ন করে দিস। আমিও রেগে বললুম, অপূর্ব লোকটাকে উইল লিখে রাখতে বলিস। এই কথাবার্তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে মেয়েদের ইস্কুল আর ছেলেদের ইস্কুলের মধ্যে কী দারুণ রেষারেষি চলছিল।
নেপু হল আবার ওদের দলের সাবক্যাপ্টেন। গলায় একটা দড়ি দিয়ে একটা বাঁশি ঝুলিয়ে বাড়ি এল। দেখে হেসে বাঁচি নে। ওদিকে আমাদের ইস্কুলেও রীতিমতো কাজ শুরু হয়ে গেছে, ছোটো ছোটো দল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আমি একটা দলের অধিনেত্রী হয়েছি। একটা লাল রেশমি ফিতের ব্যাজও পেয়েছি, আমার পেনসিল-বাক্সে সেটা লুকিয়ে রেখেছি। নেপুকে দেখাতে ভারি বয়ে গেছে। বাবা! যা হিংসুটে ছেলে, এক্ষুনি তাই নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করবে।
এ সবের মধ্যে আবার শীত পড়ে গেল। নাসপাতি গাছের পাতাগুলো সব লালচে হয়ে ঝরে পড়ে গেল। আর তারইসঙ্গে আমাদের বাৎসরিক পরীক্ষাও এসে গেল। নেপুরা শুনলুম দল বেঁধে ওদের হেডমাস্টারমশায়ের কাছে গেছল, নাকি চোর ধরার হাঙ্গামার জন্য ভালো করে পড়া তৈরি হয়নি, বড়োদিনের ছুটির পর পরীক্ষাটা হোক। তাড়া খেয়ে বাবুরা ফিরে এসেছিলেন। ওদিকে চোর ধরার নাম নেই, এদিকে তাই নিয়ে বড়াই কত! আমরাও যে পরীক্ষা পেছোবার কথা ভাবিনি তা নয়, কিন্তু নেপুদের অবস্থা দেখে কথাটা আর পাড়িনি।
সেকালে বাৎসরিক পরীক্ষার পর বারো দিন বড়দিনের ছুটি থাকত। ভেবেছিলুম তারমধ্যে কাজ হাসিল করতে পারলে কী মজাটাই-না হয়।
বাড়িতেও এইসব ব্যাপার নিয়ে বেশ একটা আলোড়ন চলত। বাবা তো খাতায় মা জেঠিমাদের নাম লিখে নিয়েছিলেন। সন্ধ্যে বেলায় জগদীশদার পিসিমা প্রায়ই একটা মোষের মতো রঙের আলোয়ান গায়ে দিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতেন। জেঠিমাদের বলে-কয়ে বাবার খাতায় তিনিও নিজের নামটা লিখিয়ে নিলেন।