এবার অরুণাবউদি নিজেই কুঁজো থেকে জল ঢেলে দিলে। জল খেয়ে গুটে বললে, এখন কৌটোটাকে বাইরের হাওয়ায় বের করা যায় কী করে? হরিসভার মহিলা সমিতিতে আমাদের চর ছিল, না পিসিমা, তার নাম কিছুতেই বলব না, তা ছাড়া সে এখানে নেইও–সে করলে কি না, পিসিমার প্রাণে চোরের ভয় ঢুকিয়ে দিল। ব্যস্, অমনি কৌটো আলোতে বেরিয়ে এল।
পিসিমা ভাঙা গলায় বললেন, নিলি কী করে?
গুটে তো অবাক! ও আর এমন কি শক্ত? ব্যাঙ্ক তো আমাদের লোকেই ঠাসা ছিল। জগদীশবাবু যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাগজে সই দিচ্ছেন তখন পকেট থেকে কৌটো সরিয়ে, কিমামের শিশিই যদি ভরে দিতে না পারে, তো আবার তারা গোয়েন্দা কীসের? কৌটোর কথা তো ব্যাঙ্কসুষ্ঠু সবাই শুনল, জগদীশবাবু এমনি ফলাও করে বললেন!
কিন্তু ঘরে এনে দেখা গেল কৌটোর মুখের হিরের প্রজাপতিটাই নেই। উঃ! বাপ! সেটি বের করতেই তো প্রাণ যাবার জোগাড় হয়েছিল।
জেঠিমা বিরক্ত হয়ে বললেন, কী বলছ, বাছা, গুছিয়ে বলো।
গুটে বললে, মানে কী বুঝলেন না? দলের লোকরা মনে করেছিল সাত দিনে কাজ হাসিল করে যে যার চলে যাবে। পিসিমা যদি প্রজাপতি না সরাতেন তো হতও তাই। আচ্ছা, ও-রকম কৌটো এক জায়গায়, প্রজাপতি আরেক জায়গায়, অন্য গয়না অন্য জায়গায় ও-রকম থানে থানে জিনিস রাখবার মানে কী?
পিসিমা বললেন, ওমা, কী বলে! এ আবার কীরকম গোয়েন্দা! এক জায়গায় জিনিস রাখি, আর সব একসঙ্গে যাক আর কী! তা ছাড়া প্রজাপতি তো খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। তোমরা কোথায় পেলে?
গুটে বললে, কী যে বলেন পিসিমা, আমরা আর পেলুম কোথায়? এদিকে দলের লোক উশখুশ করছে, তাদের কাজ না দিলে নাকি তারা স্রেফ চাকর বনে যাবে। তাই এটা-ওটা সরাবার বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল, হাতসাফাই বিদ্যেটা অন্তত চালু থাকুক! তবে যার যারটা ফিরে পেয়েছে কি না বলুন?
আমি আর থাকতে না পেরে উঠে বললুম, কোথায় সব ফিরে পেয়েছে? আলুগাছ পায়নি, পাঁঠা পায়নি, ম্যাজিস্ট্রেটের কুকুরটা পায়নি।
গুটে বিরক্ত হয়ে উঠল। কী যে বোকার মতন কথা বল দিদি। ইস্কুলে গিয়ে কী শেখ? খাবার জিনিস খেয়ে ফেললে আবার আসবে কোত্থেকে? আর কুকুরটা তো চার-পাঁচজনকে কামড়ে-টামড়ে পালিয়েই গেল। এতদিনে নাকি ফিরেছে।
হ্যাঁ, কী বলছিলাম যেন?– ও, হা সেই হিরের প্রজাপতিটে কোথাও পাই নে। তার ওপর পিসিমা দিলেন পুলিশ লেলিয়ে, পালিয়ে পথ পাই নে! শেষটা রাতে দলবল নিয়ে ওনাদের বাড়ি সার্চ করা ছাড়া উপায় থাকল না! উঃ! সে কী কাণ্ড! সেইদিন জগদীশবাবু প্রমাণ পেয়ে গেলেন যে অপূর্ববাবুরা কী উদ্দেশ্যে ওনার সঙ্গে ভাব পাকিয়েছেন। অবিশ্যি কিছুদিন থেকেই নানান কারণে ওঁর সন্দেহ হচ্ছিল। বিশেষ করে মাসিমার কাছে টাকাগুলো দেখে অবধি। ওটা একটা ভুল চাল হয়েছিল, আমি তখনি মানা করেছিলুম, তা কে শোনে! আমাকে তো সে রাত্রে বিরাশি সিক্কা ওজনের এক চড়ই কষিয়ে দিলেন– এখনও দাঁত কনকনানি যায়নি– আর অপূর্বদার ওপর মহা চটে গেলেন।
জেঠিমা বললেন, অতই যদি চটল তো পুলিশে দিয়ে দিল না কেন তোমাদের সবাইকে বাছা? অত যত্ন করে আমাদের এখানে লুকিয়ে রাখার মানেটা কী?
গুটে তো হাঁ!
বাঃ, তা রাখবেন না? আমার মতন কে বেঁধে খাওয়াতে পারে সেটা বলুন? জানেন, রাজরাজড়ারা– আর পুলিশে দেবেন কী করে? তা হলে লাবণ্যদিদির মা মলিনাদিদির সঙ্গে ওনার বিয়ে দিলেন আর কী!
ঢোক গিলে, পিসিমা বললেন, কিন্তু হিরের প্রজাপতিটা কোথায় পেলে?
গুটে একটু চুপ করে থেকে বললে, কেন, পেয়ারা-জেলির শিশিতে। সেখানে আপনিই লুকিয়ে রেখে থাকবেন। তাপ্পর শিশিসুদ্ধ দিয়ে দিলেন।
পিসিমা পুরো এক মিনিট হাঁ করে গুটের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর ঝু করে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। দরজাটাকে ঠেস দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিলেন, এবার দরজাটাও অমনি হাট করে খুলে গেল। আর গুটেও এতক্ষণ বাদে দরজা খোলা পেয়ে, নিজের বাক্সটা তুলে নিয়ে, চোঁ চোঁ যে দৌড় দিল, আর তাকে দেখিনি।
১৫.
এ সবের পরে আমাদের সেই পাহাড় দেশের ছোটো শহরটা অমনি আবার ঝিমিয়ে পড়ল। ওই এক বছরের কাহিনি আস্তে আস্তে সবার মন থেকে মুছে গেল। গুটের গল্প সত্যি কি মিথ্যে কিছুই বোঝা যায়নি। পিসিমাও এর পরেই বাড়ি বেচে কাশী চলে গেলেন।
কিন্তু নেপু নাকি কলকাতায় যখন পড়তে গেছিল, অপূর্বদাদের খোলাখুলি জিজ্ঞেস করেছিল।
তাঁরা সব শুনে শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
বলিস কী রে! ও সিঁদুরের কৌটো দুটো যে তোর লাবণ্যদিদির ঠাকুরদাদা নাতনিদের বিয়েতে দেওয়া হবে বলে কবে থেকে লোহার সিন্দুকে তুলে রেখেছিলেন! গুটেও পিসিমার ভয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলল, আর তোরাও অমনি বিশ্বাস করলি? দেখলি কাণ্ড, অবিনাশ?
আর অবিনাশ বলে অপূর্বদার একতলার ভাড়াটে, একমুখ দাড়ি-গোঁফসুদ্ধু মাথা নেড়ে বলল, অদ্ভুত! খাসা রাঁধত নাকি ওই অবিনাশ, নেপুকে খাইয়েছিল।