পিসিমা আবার চোখে একটু কম দেখেন, একে ওকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কী দিল বেয়ান তার মেয়েদের?
শেষপর্যন্ত মেয়েরা হাতের মুঠি খুলে কৌটো দু-টি তাঁকে দেখাল। লাবণ্যদিদিরটা আগাগোড়া এই বড়ো বড়ো মুক্তো বসানো। আর মলিনাদিদিরটা সোনার তৈরি, গায়ে লাল-সবুজ পাথর আর ঢাকনির ওপর এই এত বড়ো একটা হিরের প্রজাপতি ঠিক যেন এখুনি ডানা মেলে উড়ে যাবে।
পিসিমা সেদিকে একবারটি তাকিয়ে, আঁক আঁক শব্দ করে, একেবারে মুচ্ছো!
তখন জল কই, হাতপাখা কই, করে চার-পাঁচজন লোক ছুটোছুটি করতে লাগল। তারই মধ্যে মোটর ছাড়বার সময়ও হয়ে গেল। ওঁরাও চলে গেলেন।
বাড়ি ফেরার সময় পিসিমাকে ডাক্তারবাবুর টমটমে তুলে দিয়ে, আর সবাই যেমন সেকালে যেত, হেঁটে চলল।
জেঠিমা তখন লাবণ্যদিদির মাকে বললেন, কিছু মনে করবেন না দিদি, ঠাকুরঝির ফিটের ব্যামো আছে।
বাড়ি এসে মাকে বললেন, ঠাকুরঝিও যেমন! কৌটো যেন ওঁর বাবা ছাড়া আর কারও থাকতে পারে না।
মা আস্তে আস্তে বললেন, যেমন শুনেছিলাম, এটা কিন্তু অবিকল সেই রকম দেখতে।
১৪.
পরদিন লাবণ্যদিদিদের মা-রা রওনা হয়ে গেলে পর, সন্ধ্যে বেলা পিসিমা আমাদের বাড়িতে এসে বললেন, দ্যাখ দিকি কাণ্ড! ও কৌটো যদি আমার সেই হারানো কৌটো না হয় তো কী বলেছি! তা তোরা আমাকে কিছু বলতেই দিলি নে!
জেঠিমা বললেন, বাবা! কী ভয়ে ভয়েই যে কাল দিনটা কাটিয়েছিলাম। খালি ভাবি এই বুঝি তুমি বেয়ানকে বেস কিছু বলে বস! ঘরের কথা বেয়াই বাড়িতে বলতে হয় না, ঠাকুরঝি।
পিসিমা হেসে বললেন, কেন বলব? ওতো আমার জগদীশের বউয়ের জন্যই রেখেছিলাম। তা সেই যখন পেয়ে গেল, আমার আর বলবার কী থাকতে পারে? খালি ভাবি কৌটোটা যেমন করেই পাক প্রজাপতিটে পেল কোত্থেকে?
দরজার কাছ থেকে ফস করে কে বললে, সে আর আশ্চর্য কী? আপনি নিজেই যখন হাতে করে ওনাদের কাছে তুলে দিলেন।
সবাই হাঁ করে দেখি গুটে সেই হাতকাটা গেঞ্জির ওপর আলোয়ান জড়িয়ে এসে কখন দোর গোড়ায় দাঁড়িয়েছে।
মাথা চুলকে বললে, আমার বাক্সটা নিতে এলাম, মা, সার্টিফিকেটটা ওর মধ্যে কি না।–ওকী পিসিমা, দরজায় খিল দিচ্ছেন কেন? আমি যাব যে।
পিসিমা দরজায় খিল এঁটে, তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে, জেঠিমাকে বললেন, বড়োবউ, তুই ছাতাটা নিয়ে এপাশে খাড়া থাক তো দেখি। এই হতভাগা, এবার বল ওরা আমার কৌটো কী করে পেল?
গুটে আমতা আমতা করতে থাকে, আমার ওপর কারো চোখ পড়বার আগেই আমি টুপি করে বাবার বড়ো চেয়ারটার আড়ালে বসে পড়লুম। কী জানি কখন এরা আমাকে কী বলে বসে!
গুটে হঠাৎ মাথা তুলে বললে, বেশ তবে বলেই ফেলি, আমার আর কী? গোড়া থেকেই শুনুন তবে। একটু বসতে পারি?
বলে মাটিতেই আসন পিঁড়ি হয়ে বসে পড়ে বললে, গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে, যদি একটু চা—
জেঠিমা কর্কশ গলায় বললেন, ওই কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খাও, বাছা। সব কথা শোনবার পর চা আর মালপো দেব।
গুটে তো মহা খুশি।
তাহলে সব কথাই শুনুন। অপূর্ববাবুদের অবস্থা এককালে খুব ভালো ছিল, আমার বাবা ওঁদের বাড়ির সরকার ছিলেন। আমি ওখানেই মানুষ হয়েছি। ম্যাট্রিক পাশ করে, গোয়েন্দাগিরি শিখেছি ওনাদের খরচায়। তবে অবস্থা এখন পড়ে গেছে।
গত বছর পুজোর সময় জগদীশবাবু কলকাতা গেছলেন মনে আছে তো? সেইভেনে অপূর্ববাবুদের সঙ্গে আলাপ। লাবণ্যদিদির সঙ্গে অপূর্ববাবুর বিয়ে ঠিক হয়েছে, কিন্তু দিদিমণির মা কিছুতেই বিয়ে দেবে না যদ্দিন না কি এক সোনার কৌটো খুঁজে পাওয়া যায়। ওনার শ্বশুরের জিনিস, কে এক জোচ্চোর বদমাশ চালাকি করে হাতিয়ে নিয়েছে–
এই অবধি বলেই জিভ কেটে, গুটে পিসিমাকে বললে, কিছু মনে করবেন না, পিসিমা, গুটে নস্করের মুখ থেকে সর্বদাই হক কথা বেরিয়ে পড়ে।
পিসিমা বললেন, বাজে কথা রাখো! তারপর কী হল?
তারপর আর কী হবে? লাগাও গুটে গোয়েন্দাকে, সে জোচ্চোর বুড়োকে খুঁজে বের করুক। দেরিও হল না বের করতে, জগদীশবাবুই কথায় কথায় সব ফেঁসে দিলেন। হল কী, লাবণ্যদিদি মলিনাদিদির জন্মদিনে ওনারও নেমন্তন্ন হল। প্রেজেন্ট দিলেন একমুঠো সেকালের টাকা! সে টাকা তো আপনারা পরে বোর্ডিঙের মাসিমার কাছে দেখেওছেন- যাকগে সে কথা। তাপ্পর আর কী, এখেনে ইস্কুলে সব চাকরি খালি আছে, সেও জগদীশবাবুর কাছেই শোনা। অপূর্বাবু আপিস থেকে এক বছরের ছুটি নিয়ে এখানে চলে এলেন। লাবণ্যদিদিও মেয়ে ইস্কুলের বড়োদিদিমিণি হয়ে বসলেন।
আমিও এলাম আমাদের গোয়েন্দা সিন্ডিকেটের যতসব বেকার গোয়েন্দা জুটিয়ে এনে। কৌটো উদ্ধার করতে হবে তো। লোক নইলে চলবে কেন।
নিজে গা ঢাকা থেকে, ঘরে ঘরে দলের লোক চাকর সাজিয়ে ঢোকালাম। বিশ্বাস না হয় খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন এর মধ্যে সবার বাড়ির এক-আধটা ভালো চাকর ভেগেছে কি না। আমাদের সব ট্রেনিং দেওয়া লোক, করুক তো কোনো সত্যি চাকর ওদের মতো কাজ?–একটু চা নইলে সত্যি আর বলতে পারছি নে মা।
জেঠিমা খিল খুলে চা করতে গেলেন, বাকিরা পাহারায় থাকল। কারো মুখে কথা নেই। গুটে বার বার বলতে লাগল, গোয়েন্দাগিরি কি সোজা কথা, পিসিমা? এর জন্যে কী না করতে হয়।
ততক্ষণে চা এসে গেল, চা খেয়ে গুটে বললে, পান। মা পেতলের বাক্স থেকে দুটো পান দিলেন। গুটে বললে, চুন। মা চুন দিলেন। গুটে বললে, হা, তাপ্পর শুনুন। সমিস্যে হল কৌটো জগদীশবাবুদের বাড়িতে থাকলেও, সে-বিষয় জগদীশবাবু যে কিছুই জানে না সেটা ঠিক। কিছু মনে করবেন না, পিসিমা, ওনাকে একটু মাছের মুড়ো খেতে বলবেন, তাতে বুদ্ধি খোলে। অবিশ্যি আমাদের তাতে সুবিধে হল এই যে ওনার কাছ থেকে মেলা খবর বের করে নেওয়া গেল, উনি আমাদের এতটুকুও সন্দেহ করলেন না। একটু জল খাব।