আর দিনরাত কেবল জগদীশদার প্রশংসা। কেমন সোনাহানা মুখ করে যা দেওয়া যায় তাই খায়। সাত চড়ে রা নেই–এইসব। আমরা তো দেওয়ালে সেই পিন দিয়ে কাগজ আঁটার কথা, শশীদিদির গালে চড়ের দাগের কথা মনে করে, হাঁ হয়ে যেতুম।
তার ওপর বউমাকে আশীর্বাদ করবেন বলে সুন্দর এক পুরোনো গয়নাও বের করলেন। জেঠিমা তো রীতিমতো চটেই গেলেন, কীরকম কঞ্জুস বুড়ি দেখলি? এতকাল এর বাড়ি ওর বাড়ি ফলপাকুড়টা, ক্ষীর সন্দেশটা খেয়েই বেড়িয়েছে। হাত উপুড় করে একটা পয়সা ঢালেনি। অথচ ঘরে তার এত দামের গয়না!
পিসিমা ওদিকে জাঁক করে বলে বেড়াতে লাগলেন, বাবা, আমি কি তেমনি মেয়ে! কৌটো পাবামাত্র পেতলের হাঁড়িতে উটিকে ভরে, রান্নাঘরের মেঝেতে তিন হাত মাটি তুলে, রাতারাতি পুঁতে ফেললাম। তাপ্পর তার ওপর উনুন পেতে দিব্যি রাঁধাবাড়া করতে লেগে গেলাম! আর এও সত্যি বলছি, তারপর থেকে ডাল ঝোলগুলোও খেতে লাগত যেন মদু! উদিকে দেওয়ালের ওধারে ডাকাতের সর্দার গুটে নিশ্চিন্তে রাঁধছে, আর সুবিধে পেলেই এঘর-ওঘর হাতড়ে বেড়াচ্ছে! ওই কানের ফুলটি ছবির পেছনে লুকিয়ে রেখে ভুলেছিলুম, ব্যস্ অমনি সেটি গাপিয়েছে! কিন্তু এটাতে কিছুতে হাত লাগাতে পারেনি!
বলেই পিসিমা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। মা-রা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ও কী ঠাকুরঝি? বুক ধড়ফড় কচ্ছে নাকি? ওরে, হাতপাখাটা নিয়ে আয়!
পিসিমা মাথা নেড়ে বললেন, না, না, শরীর খারাপ হয়নি, হিরের প্রজাপতি কেমন করে নিল তাই ভাবছি! আবার চিঠি লিখে জানাল সেকথা! অথচ একদিনও চোখে দেখলাম না ওদের!
লাবণ্যদিদিদের বাড়িতে লোক ধরে না। ওঁর মা কাশী থেকে বেনারসি শাড়ি আনিয়েছেন, দূর দূর পাড়া থেকে মেয়েরা তাই দেখতে আসে। তখন এসব শৌখিন জিনিস বেশি দেখবার। সুযোগই পেত না কেউ।
কলকাতা থেকে গয়না গড়িয়ে এনেছেন। তবে পিসিমার ওই পুরোনো কানবালা জোড়ার কাছে সেসব দাঁড়াতেই পারে না।
দলবল নিয়ে জগদীশদাও এল বিয়ের দুদিন আগে। অপূর্বদার বাড়িতে উঠল সব। এখন দেখি দু-জনার ভারি ভাব। অথচ দু-মাস আগেও জগদীশদার কাছে অপূর্বার নাম করা যেত না!
জগদীশদাকেও চেনা যায় না। এই অল্প সময়ের মধ্যেই চেহারাটা দিব্যি চেকনাই হয়েছে। সিল্কের পাঞ্জাবি, জংলা শাল, সাদা পাম্পশু পরেছে।
তার পরে চল্লিশ বছরের ওপর কেটে গেছে, কিন্তু সেই ডবল বিয়ের কথা আমার আজও মনে আছে। বিয়ের আগের দিন, পাড়ার ছেলেরা পাড়ার ক্লাবের পক্ষ থেকে কংস-বধ থিয়েটার করল। শহর ভেঙে সব দেখতে এল। সে থিয়েটারের কথাও আমি ভুলিনি। কীসব চেহারা, মঞ্চের ওপর লাফিয়ে চড়ে কংসের সে কী আস্ফালন! এই বড়ো বড়ো লাল চোখ ঘুরিয়ে সে কী তর্জন-গর্জন! ভয়ে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁদিয়ে গেছল! তারপর মল যখন, উঃ, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম!
তখন সবে শীত পড়ে আসছে, হিমেতে আর চাঁদের আলোতে চারদিক ঝিকমিক করছে। অথচ এতটা ঠান্ডা পড়েনি যে বাইরে বেরুতে কষ্ট হয়।
মফস্বল শহরে তখনকার দিনে বিয়ের খাওয়া-দাওয়াও আলাদা রকমের ছিল। এই বড়ো বড়ো লুচি, ছোলার ডাল, কুমড়োর ছোঁকা আর পাঁঠার মাংস। রাঙা আলুর অম্বল, টক দই আর লাল লাল বোঁদে। তার ওপর লাবণ্যদির মা কলকাতার মেয়ে, রাশি রাশি পান্তুয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সবাই তাঁর খুব প্রশংসাও করেছিল।
লাবণ্যদি আর মলিনাদিকে সেজেগুঁজে পাশাপাশি বসে, দেখাচ্ছিল যেন পরিদের দুই রানি!
আমরা সেজেগুজে, ঘুরে ফিরে, খেয়ে-দেয়ে, পান চিবিয়ে গাল পুড়িয়ে, এমন ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম যে শেষপর্যন্ত বাড়ি এসে, কাপড়চোপড় ছেড়ে লেপের মধ্যে ঢুকতে পারলে বাঁচি। নেপু নাকি তেরোটা পান খেয়েছিল। দুটো পান পাঞ্জাবির পকেটে করে বাড়িতেও এনেছিল, এমনি অসভ্য! পকেটে খয়েরের দাগ লাগার জন্যে, তেমনি বকুনিও খেয়েছিল জেঠিমার কাছে।
বড়দা, নেপু, বাবা, জ্যাঠামশাই সব গেছলেন অপূর্বার আর জগদীশদার বরযাত্রী হয়ে। আমরা মেয়েরা হলুম কনে বাড়ির লোক। এমনি করে সেই ডবল বিয়েটা হয়েছিল।
শুনলুম, লাবণ্যদি মলিনাদি নাকি যমজ বোন, ওদের মা দু-জনাকে সব একরকম জিনিস দিয়েছিলেন।
তারপর দিন রাত্রে অপূর্বদা আর জগদীশদা সবাইকে বায়োস্কোপ দেখালেন। সেকালে কেউ সিনেমা বলত না, সবাই বলত বায়োস্কোপ। সে শুধু দেখা যেত, কানে শোনা যেত না, ছবির নীচে নীচে কথাবার্তা লেখা থাকত, আর একদল সায়েব মতন লোক কোট-পেন্টেলুন পরে, থেকে থেকে হারমোনিয়ম, বেহালা, ক্ল্যারিয়োনেট বাজাত।
বায়োস্কোপ দেখানোর পর খুব খাওয়াল অপূর্বদারা, চা শিঙাড়া, খাস্তা কচুরি আর নানারকম মণ্ডামেঠাই।
তার পরদিন সকালের মোটরে অপূর্বদা, জগদীশদা, লাবণ্যদি, মলিনাদি দলবলের কয়েক জনের সঙ্গে চলে গেলেন।
আমরাও ফুলের মালাটালা নিয়ে, মোটর আপিসে গিয়ে খুব কেঁদে-কেঁদে ওঁদের বিদায় দিলুম। লাবণ্যদিদিদের মা বাকি দলবলের সঙ্গে জিনিসপত্র গুছিয়ে তুলবেন বলে আরও এক দিন থেকে গেলেন।
মোটর ছাড়বার ঠিক আগে, সকলের সামনে তিনি হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে, কেঁচড় থেকে দুটো সিঁদুর কৌটো বের করে, মেয়েদের হাতে দিয়ে বললেন, ওরে এগুলো তোদের ঠাকুরদা তোদের জন্যে রেখে গেছিলেন। যত্ন করে রাখিস।