নেপুও চটে গেল, মোটেই ভূতের ভয়ে নয়। ওর হাঁপানির রোগ আছে।
বললুম, রেখে দে তোর হেঁপো মাস্টারের কথা!
নেপু রেগে পেয়ালা থেকে অনেকখানি দুধ মাটিতে ঢেলে ফেলে দিয়ে বললে, রেখে দে তোর ললিতা মাস্টারনির কথা।
কীরকম আস্পর্ধা দেখলে তো? কীসের থেকে কী টেনে আনা। ওই বলে আবার দুম দুম করে পা ফেলে খাটে গিয়ে শুল!
সে যাই হোক গে, আস্তে আস্তে সবাই সেরে উঠলুম। মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেলুম, ঘর থেকে ছাড়া পেলুম। মাসের ছুটির সঙ্গে, পুজোর বারো দিন ছুটি জুড়ে, মস্ত লম্বা ছুটির পর শেষটা আবার ইস্কুল খোলবার সময় হয়ে গেল। বোর্ডিঙের মেয়েরা ফিরে এল। শুনলুম ললিতাদি, লাবণ্যদি এসেছেন। নেপুর অপূর্বদাও এলেন।
তখনও ইস্কুল খুলতেদু-দিন বাকি আছে, জগদীশদার পিসিমা দিন চারেক হল বাড়ি গেছেন, ও-দিকটাতে ভাড়াটে এসে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে সন্ধ্যে বেলা আমাদের বাড়িতে ছুটে এলেন। খুশিতে ফেটে পড়েছেন।
ও বউমা, ওরে মিনু, ওরে নেপু, সুখবর শুনেছিস? ডবল বিয়ের নেমন্তন্ন খাবি যে সবাই! অপূর্বর সঙ্গে লাবণ্যর বিয়ে, আর জগদীশের সঙ্গে লাবণ্যর বোন মলিনার বিয়ে। লাবণ্যর মা-টা সবাই আজ এসে পৌঁছোলেন, এখানেই বিয়ে হবে।
বুকটা ধড়াস করে উঠল। লাবণ্যদির সঙ্গে গুঁফো অপূর্বদার বিয়ে তাই কখনো হয় নাকি?
পিসিমা আরও বললেন, নাকি জগদীশদাও আসছে। বিয়ের পর অপূর্বদারাও চলে যাবে। জগদীশদার আপিসেই কাজ করবে। আগেও নাকি তাই করত। জগদীশদার কাজ নাকি ও-ই ঠিক করে দিয়েছিল। কী জানি!
হয়তো সবাই কলকাতায় গিয়ে ট্রামরাস্তার ওপর থাকবেন, ঘড়ঘড় করে সামনে দিয়ে ট্রাম যাবে, মাথার ওপর বিজলি পাখা ঘুরবে, সন্ধ্যে হলে কুলপি বরফওয়ালাকে ডেকে সবাই কুলপি খাবেন।
সেই পাহাড় দেশের প্রচণ্ড শীতে, লেপের ভেতর পা গুটিয়ে শুয়ে, এসব কথা মনে করে দারুণ কান্না পেতে লাগল।
কিন্তু নেপুটার এতটুকু দুঃখ নেই। আবার সে কী তড়পানি! বললে, ভালোই তো, আসছে বছর আমার বারো পুরবে, তারপর তিন বছর বাদে পরীক্ষেটা কোনোমতে পাস করে নিয়েই, কলকাতা চলে যাব! ব্যস্, আর কী? হস্টেলে থাকব, রোজ সন্ধ্যে বেলা অপূর্বর্দার বাড়িতে গিয়ে মালাই বরফ খাব। তোর লাবণ্য মাস্টারনি রাঁধতে পারে তো?
চব্বিশ ঘণ্টা কেবল খাবার তালেই আছে। আমি কিন্তু রোজ রাত্রে বালিশে মুখ গুঁজে খুব কেঁদে নিতুম।
ইস্কুলের মেয়েরা সবাই চাদা তুললুম। লাবণ্যদিকে খুব ভালো করে ফেয়ারওয়েল দিতে হবে। সুখে থাকো লেখা সোনার পিন কেনা হল, সাড়ে তেরো টাকা দিয়ে। তখন সোনা কত সস্তা ছিল; সবাই শাড়ির কাঁধে সোনার পিন লাগাত।
এসব নিয়ে নেপুর সে কী বিশ্রী হাসাহাসি। বলে, কী রে তোদের বালতি-টালতি কেনা হল? নইলে মেয়েরা চাঁদা করে কাঁদাকাটি করবে কী করে?
এই ধরনের ঠাট্টা আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি নে। তবু চুপ করে থাকলুম, নইলে আরও কত কী বলবে, বিশ্বাস কী!
অরুণাবউদি কিন্তু আচ্ছাসে ওর কান পেঁচিয়ে দিয়ে বললেন, মেয়েদের একটু সমীহ করতে শেখ, লক্ষ্মীছাড়া!
তখন একটু না হেসে পারলুম না। লাবণ্যদি নিজে একদিন আমাদের বাড়ি এসে দেখা করে গেলেন। মাখনের মতো রঙের একটি শাড়ি পরে কী যে সুন্দর সে আর কী বলব!
আমার গালে একটা চুমো খেয়ে বললেন, কলকাতায় গেলে, আমাদের বাড়িতে যেয়ো, কেমন?
শুনে খুব আনন্দও লাগল, আবার কান্নাও পাচ্ছিল। তারপর মাকে বললেন, শেষটা ভূতের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র উদ্ধার হল! সেদিন আমরা যখন সেখানে গিয়ে কানের ফুল কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, তখনি আমার সন্দেহ হয়েছিল। তবে বড় অন্ধকার ছিল কি না, ভালো করে খোঁজাই গেল না। নইলে আমরাই হয়তো পেয়ে যেতাম।
সত্যি, কী বুদ্ধি যে লাবণ্যদির। ওঁর বোনকেও সঙ্গে এনেছিলেন, তিনিও ওঁরই মতন সুন্দরী, তবে আমার ওকে ততটা ভালো লাগেনি। কেমন যেন একটু দেমাকি বলে মনে হল। কথাই বললেন না ভালো করে। তবু জগদীশদার সঙ্গে বিয়ে হলে একটুও মানাবে না মনে হল। কী কাঠ-কাঠ হাত-পা জগদীশদার, মাথায় কী কম চুল!
চারিদিকে তখন বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো কথা নেই। লাবণ্যদির মা আমাদের জন্যে পুলিপিঠে করে পাঠিয়ে দিলেন। বাবা জ্যাঠামশাই মহা খুশি।
তবু ওই চুরির কথাটা আমার প্রায়ই মনে হত। আর পিসিমার তো মহা দুঃখ, অ্যাদ্দিন বাদে বউমা আসছে ঘরে, কিন্তু সিঁদুর রাখবার জন্যে হিরের প্রজাপতি-বসানো সোনার কৌটোই নেই!
১৩.
সেকালের ব্যাপার ছিল আলাদা। লোকে থাকত ভারি সাদাসিধেভাবে। বিকেলে কেউ কারো বাড়ি গেলে, গরম লুচি ভেজে, লাল কাশীর চিনি দিয়ে খেতে দিত। বেশি দামের কাপড়চোপড় পরারও রেওয়াজ ছিল না।
তবে বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে কারো বিয়ে থা হলে পাড়াসুদ্ধ এসে জুটে যেত। পরামর্শ দিত দেদার, সাহায্যও কম করত না।
এক মাস আগে থাকতে হইচই লেগে যেত। মফস্বল শহর, সব বন্দোবস্তই আগে থাকতে করতে হত। ব্যাবসাদাররা, কারিগররা বায়না নিয়ে, এক মাস আগে থেকেই কাজে লেগে যেত। আর এবার তো মাস খানেকও নেই, তারপর ডবল বিয়ে! ঝগড়াঝাটি ভুলে, সবাই মিলে আমোদ করতে লেগে গেল।
কোথায় মেরাপ বাঁধা হবে, ক-শো চেয়ার পড়বে, কী খাওয়া হবে, কী দেওয়া হবে, এখন সবার মুখে কেবল ওই এক কথা।
জগদীশদার পিসিমা নতুন মানুষ বনে গেলেন। আনন্দের চোটে মোষের মতো রঙের আলোয়ানটা চাকরটাকে দিয়ে দিলেন। কাঁঠাল কাঠের বাক্স খুলে পুরোনো একখানা হলদে হয়ে-যাওয়া গরদ বের করে পরলেন। বাদামি রঙের একটা কাশ্মীরি শাল গায়ে জড়ালেন। গলায় একটা দশভরি বিছে হার পরলেন।