তারপর হাঁক-ডাক, থানা-পুলিশ, খানাতল্লাশি। কিন্তু কিছুতেই আর কিছু হল না। সোনার কৌটো কর্পূরের মতো উড়ে গেল।
এ-সমস্ত ঘটনা পরে জগদীশদার নিজের মুখ থেকে শোনা।
আর শুধু কি সোনার কৌটো? সেদিন থেকে আমাদের ছোটো শহরে, যেখানে কখনো কিছু ঘটে না বলে লোকে আক্ষেপ করত, সেখানে যেন ভোজবাজি শুরু হয়ে গেল। সে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবার কথা নয়। যেখানে আগে সবাই দরজা খুলে বেড়াতে যেত, সেখানে আর কারো কিছু রাখবার উপায় রইল না। যার যা ভালো জিনিস, সব বেমালুম চুরি হয়ে যেতে আরম্ভ হয়ে গেল!
অদ্ভুত সব ব্যাপার! বিশেষ করে স্কুল পাড়ায়, যেখানে আমরা থাকতুম। আমাদের শহরটা ছোটো হলেও, পাড়াগাঁর মতো নয়। বলেছিই তো আপিস, আদালতে, থানা, জেলখানা, ছেলেদের ইস্কুল, মেয়েদের ইস্কুল, হোটেল, ক্লাব, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক কিছুরই অভাব ছিল না। রেলগাড়ি অবিশ্যি ওইসব পাহাড়ে দেশে যাতায়াত করত না, কিন্তু মস্ত একটা মোটর-আপিস ছিল, সেখানে মেলা লোজনও কাজ করত।
জগদীশদার কৌটো যাবার পরদিনই আমাদের স্কুলের বড়দিদিমণির সেলাইকটা গেল। তারপর দু-চার দিন পর পর, গুপেদের হেডমাস্টারের টাইপরাইটার, ব্যোমকেশবাবুর দু-দুটো ছাগল, আর পোস্টমাস্টারের সাইকেল উধাও!
সেখানেই থামল না। আমাদের কালেক্টর গুপ্ত সাহেবের দেয়ালঘড়ি, গ্রামোফোন আর বারান্দায়-ঝোলানো দশ রকমের অর্কিড ফুলের গাছ লোপাট! এমনকী সেগুলোকে পাহারা দেবার জন্যে গুপ্ত সাহেব যে হলুদ রঙের ডালকুত্তো কিনেছিলেন, যার ভয়ে বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত কেউ নীচু হত না, কারণ নীচু হলেই পেছন দিক থেকে তেড়ে এসে একাকার করত সে কুকুরটা পর্যন্ত নেই।
পুলিশে আর কী করবে? শোনা গেল থানার বড়ো ঘণ্টাটা আর পুলিশদের চব্বিশটা পেতলের লোটাও নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রথম প্রথম এসব শুনলে আমাদের দারুণ মজা লাগত, কিন্তু শেষটা যখন আমাদের বাড়ি থেকে, আমাদের ভালো কাপড়জামাসুদ্ধ বড়ো কালো তোরঙ্গটা অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন মোটেই হাসির কথা হল না।
সবাই ভারি সাবধানে চলাফেরা করতে লাগল। কিন্তু হলে হবে কী? চোররা আরও সেয়ানা। ডাক্তারবাবু বললেন, আর সেয়ানা হবে নাই-বা কেন? বোকা হলে তো সৎপথেই থাকত!
এমন কথা শুনে মা-জ্যেঠিমারা খুব বিরক্ত হয়েছিলেন।
তারপর কত কাল কেটে গেছে, তবু এখনও সেসব কথা ভাবতে আশ্চর্য লাগে। আমার জ্যাঠতুতো ভাই নেপু বলেছিল যে পিসির কাছে তাড়া খেয়ে, জগদীশদা নাকি তিনজন সাক্ষী ডেকে, তামা-তুলসী-গঙ্গাজল ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে চোর সে ধরবেই, সে যেমন করেই হোক। তাই নিয়ে রাত্রে ওরা লুচি মুরগি বেঁধে খাওয়া-দাওয়া করেছিল; তাই আর এখন কথার নড়চড় হবার জো নেই।
সেসময় শহরের মধ্যে যেখানেই যাও-না কেন, সবখানেই ওই এক কথা, কে নিল, কে নিল, কেমন করে নিল, কোথায় রাখল।
আমাদের স্কুলের মেয়েরাও টিফিনের সময় রোজই খুব জটলা করত। একদিন ইন্দুদি দেখলুম খালি হাতে ক্লাসে ঢুকলেন। এসেই বললেন, মেয়েরা, তোমরা সময় থাকতে সাবধান হও। পরে আপশোস করে কোনো লাভ হবে না।
শুনেই তো আমরা যে যার চুড়ি, বালা, গলার হার আর কানের ইয়ারিং খুলে, ইহুদির ডেস্কে চাবি বন্ধ করে ফেললুম। তারপর টিফিনের সময় সবাই মিলে ডালিম গাছের নীচে খাবারটাবার খেলুম, গালগল্প করলুম। ফিরে এসে যখন ডেস্ক খোলা হল, দেখা গেল, ওমা কী সর্বনাশ, গয়নাগাটি হাওয়া!
আমাদের নতুন বড়ো দিদিমণি, লাবণ্যদি তাই নিয়ে মহা গোলমাল করলেন। ইন্দুদি কেঁদেকেটে একাকার; বাড়িতেও বকাবকি। থাক, সেসব কথা ভেবে কোনো লাভ নেই।
রাত্রে খেতে বসে, নেপুর যেমন স্বভাব, ফোঁপরদালালি করে বলল, আমাদের অপূর্বদা বলেছিলেন, এ-সমস্ত কোনো ফন্দিবাজ মেয়েচোরের কাজ। এতটা নীচ, ছোটোলোক আর ধূর্ত হওয়া শুধু স্ত্রীলোকেরই সাজে।
রাগে আমার গা জ্বলে গেছিল। কিন্তু আমাকে আর কিছু বলতে হয়নি। মা, জ্যেঠিমা আর অরুণা বউদি বাছাধনকে আচ্ছা করে দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন।
সত্যি, ওদের ওই অপূর্বদাটি একটি দেখবার মতো জিনিস। ইয়া লম্বা-চওড়া, তার ওপর গা ময় পাকানো পাকানো দড়ির মতো সব মাল, এই কুটি কুটি ছোট্ট করে চুল কাটা, কিন্তু কান পর্যন্ত টানা গোঁফ! নেপুটাকে একরকম অপূর্বার চেলাই বলা যায়, নেহাত গোঁফটা গজায়নি।
জ্যেঠিমা নেপুকে বললেন, পাকামো রাখ, ওই অতবড়ো তোরঙ্গ, গ্রামোফোন সরানো মেয়েমানুষের কাজ না আরও কিছু! ওসব পাচার করতে একটা ষণ্ডামার্কা পুরুষ মানুষের দরকার।
অরুণাবউদি বললেন, আর তার গোঁফ থাকলে তো কথাই নেই!
নেপু রেগে চটে পাতে দু-খানা গোটা হাতের রুটি ফেলেই উঠে চলে গেল।
বড়দা একটু হেসে বউদিকে বললেন, ওরকম বলতে হয় না। নেপুরা তা হলে তোমার নামে মানহানির মামলা করবে!
যাই হোক, চারিদিকে কতরকম জল্পনা-কল্পনাই চলতে লাগল, তার ঠিক নেই। শেষপর্যন্ত এমন হল যে সবাই সবাইকে সন্দেহ করতে লাগল।
একদিন ডাক্তারবাবুর গাড়ি থামিয়ে নতুন পুলিশ ইন্সপেক্টর ওঁর ব্যাগ তল্লাশি করলেন। ডাক্তারবাবু হাঁ হাঁ করে তুলোর প্যাকেট সরিয়ে রাখাতে, সন্দেহজনক লোকদের তালিকায় ওঁর নামটাও লিখে রাখলেন। পরে অবিশ্যি দারুণ পেটব্যথা হওয়াতে ডাক্তারবাবুর পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন।