গল্প বলার মাঝে মাঝে এক-এক বার সবাই থেমে যাচ্ছে, আর অমনি বাইরের গাছ থেকে পাতা খসার শব্দ, টিনের ছাদের মটমট শব্দ, বাড়ির পেছনে ছোটো নদীর ওপারে সরল গাছের বনে হু-হুঁ করে বাতাস দেওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
অদ্ভুত সব চুরির গল্পও হল। তার কাছে আমাদের এখানকার চুরির কথা কোথায় লাগে!
জেঠিমাদের বংশ-পরিচয়তে লেখা আছে যে বাংলাদেশে এসে বসবার আগে, ওঁদের পূর্বপুরুষরা বেহারে কোথাও থাকতেন। তারা নাকি সেখানকার রাজা ছিলেন! একদিন ছেলেরা সব মৃগয়া করতে গেছেন, আর মেয়েরা সেই সুযোগে, দরজায় বড়ো বড়ো কুলুপ এঁটে, দাস-দাসী, পাহারাওয়ালা, সেপাই-সান্ত্রি সব নিয়ে গ্রামের মাঠে ছট পুজো দেখতে গেছেন। ভোরবেলা বাড়ি ফিরে দেখেন সব ভোঁ ভোঁ, কোথাও কিছু নেই! বাড়িঘর, পুকুর, বাগান, বাঁধানো ঘাট, কোনো কিছুর এতটুকু চিহ্ন নেই। চারদিকে শুধু অসংখ্য হাতির পায়ের ছাপ। এইসব কারণেই বেহার ছেড়ে ওঁরা বাংলাদেশে এসে বসতি করতে লাগলেন।
জগদীশদার পিসিমাও ক-দিন আমাদের এখানে আছেন। একা বাড়িতে ভয় করে। পুবের আধখানাতে ভাড়াটে এলেই আবার নিজের বাড়িতে ফিরে যাবেন।
ওইসব গল্প শুনতে শুনতে পিসিমা একেবারে জেঠিমার গা ঘেঁষে বসে বললেন, বাবা! এসব কথা শুনলেও গায়ে কাঁটা দেয়। তবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। দশ বছর আগেও ও বাবা! ওটা কী?
ঠক করে কী একটা ভারী জিনিস জানলার একটা শার্সি ভেঙে পিসিমার কোলের কাছে পড়ল। পিসিমা প্রায় ভিরমি যান আর কী! আমি সেটাকে তুলে দেখি একটা বেশ বড় নুড়ি পাথরের চারদিকে জড়ানো একটা সাদা কাগজ, তাতে লাল পেনসিল দিয়ে আঁকাবাঁকা হরফে লেখা, প্রজাপতির জন্যে ধন্যবাদ।
চিঠি পড়ে পিসিমার সত্যি সত্যি হাত-পা এলিয়ে গেল। জেঠিমার গায়ে একেবারে ঢলে পড়লেন।
এমনি সময় বাবা আর জ্যাঠামশাই ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে কী সব বলাবলি করতে করতে এসে উপস্থিত হলেন। ডাক্তারবাবু আমাদের পেট-টেট টিপে, ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন, তারপর তোমাদের গোয়েন্দাগিরির তা হলে এখেনেই ইস্তফা, কী বল নেপুবাবু? নেপু বললে, কেন কেন!
ডাক্তারবাবু খুব হাসলেন, ওমা খবর শোননি বুঝি? থানায় যে উড়ো চিঠি এসেছে, জঙ্গলের মধ্যে ভূতের বাড়ির দেয়ালের মধ্যে চোরাকুঠরিতে সব চোরাইমাল গুম করা আছে। আর অর্কিড ফুল কোথায় জান? ম্যাজিস্ট্রেটের সামনের বারান্দা থেকে তুলে নিয়ে, আস্তাবলের পেছনের বারান্দায় ঝোলানো!– আচ্ছা, এবার তাহলে সোনাহানা মুখ করে এই তেঁতো ওষুধগুলো গিলে ফেলো দিকিনি। আঁ, এই ঠিক হয়েছে, এবার বাছাধনরা যে যার শুয়ে পড়ো তো।
ডাক্তারবাবু ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে হাসতে পাশের ঘরে গিয়ে বসলেন, অনেক রাত অবধি গল্পগুজব চলল। মা জেঠিমারাও কেউ আমাদের ঘরে এলেন না। আমরা খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে, যে-যার লেপ গায়ে দিয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম,এ আবার কী কথা! চোর কি তাহলে ধরা পড়বে না? যে জিনিস ফিরিয়ে দেয় সে কি চোর?
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।
১২.
পরদিন শহরে সে কী হইচই! সে সময়কার কথা বললে সহজে কেউ বুঝতে পারবে না। সারা বছর শহরটা যেন ঘুমিয়ে থাকত, একটা কিছু ঘটলে হঠাৎ জেগে উঠে বসত। তাই নিয়ে সে যে কী উত্তেজনা চলত, যারা আজকাল শহরে বাস করে, তারা কোনমতেই বুঝতে পারবে না।
বাজার পর্যন্ত ভালো করে বসল না সেদিন। সকালে দুধওয়ালা, রুটি-মাখনওয়ালা, ডিমওয়ালা কেউ এল না। মাছওয়ালাও অনেক বেলা করে এসেছিল, তাও নেহাত না এলে মাছ পচে যেতে পারে বলে।
দলে দলে সবাই বনের মধ্যে ভূতের বাড়িতে কী পাওয়া গেল দেখতে চলল।
বড়দাও গেছল। এসে বলল, দুটো দেয়ালের মাঝখানে লুকোনো একতি ফালি ঘর। দরজার মাথার ওপর নকশাকরা একটা ফুল, তারি মাঝখানটা টিপলে, পাশের দেয়ালের খানিকটা ফাঁক হয়ে গিয়ে, চোরাকুঠরি বেরিয়ে পড়ে।
মাটি থেকে ছাদ অবধি জিনিসপত্রে ঠাসা। যেখানকার যেমন হারিয়েছিল ঠিক তেমনি অবস্থায় রাখা হয়েছে। অবিশ্যি খাবার জিনিসগুলো নেই। ম্যাজিস্ট্রেটের কুকুরটাও নেই।
সারাটা দিন, তারপর আরও চার-পাঁচ দিন লেগেছিল, নিজেদের জিনিস চিনে নিয়ে, পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে।
জিনিস হারানোর সময় যত-না হুলস্থূল হয়েছিল, এ তার চাইতেও বেশি হল।
আমাদের বাক্সটাও বন্ধ অবস্থাতেই পাওয়া গেল। বাক্সের ওপর একটা পাথরের থালা চাপানো ছিল, সেটাসুদ্ধু তেমনি রয়েছে।
বিকেলে জেঠিমা বললেন, একে আবার চুরি বলে না কি? জিনিস না হারালে আবার চুরি কী?
জগদীশদার পিসিমা বললেন, জিনিস হারায়নি তো আমার সোনার কৌটো কই? হিরের প্রজাপতিটে কই? তোদের এত ফুর্তি কীসের গা? চোর ধরা পড়বে না? তার সাজা হবে না? আমার জিনিস ফিরে পাব না?
নেপু বললে, ইস্কুল খুললে, অপূর্বদা এসে একবারটি দেখলেই সব বুঝে নেবেন। অপূর্বদা বলেছেন বিলেতে কিছু চুরি গেলে, ঘরের জিনিসপত্রের ওপর কী-একটা গুঁড়ো ছড়িয়ে, তার ফোটো তোলা হয়। ব্যস, চোরের আঙুলের ছাপের ছবি পাওয়া যায়। তাপ্পর আর কী, ওই ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দু-দিনেই চোর গ্রেপ্তার হয়। দেখিস এসেই ওইসব করাবেন।
শুনে পিত্তি জ্বলে গেল। বললুম, রেখে দে তোর গুফো মাস্টারের ক্যারানি! ভূতের ভয়ে রাতে জানলা না বন্ধ করলে যার ঘুম হয় না, তার আবার কথা!