একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, একটু হেসে পিসিমা আবার বললেন, তবে একটা ভালো হয়েছে এই যে সে বুড়োও আরও কৌটো ভরে নাতনির বিয়েতে সিঁদুর দিতে পারবে না!
সবচাইতে আশ্চর্য ব্যাপার হল যে প্রায় এক বছর ধরে এত সব হাঙ্গামার পর আবার আমাদের শহর আগেকার মতন চুপচাপ হয়ে গেল। আবার সবাই বলতে লাগল, এখানে কোনো দিনও কিছু হয় না, বিশ্রী একটা জায়গা। আবার ডিমওয়ালার, রুটিওয়ালার কাছ থেকে সবাই এর। বাড়ির ওর বাড়ির খবর জোগাড় করতে লাগল। আমার একটুও ভালো লাগত না। এত যে জিনিস গেল, চোর ধরা পড়বে কবে?
শশীদিদির জন্য মন কেমন করত, রোজ নেপুকে আমাকে এটা-ওটা ভেজে খাওয়াত। অথচ সেই যে চলে গেল আর তার টিকিটির দেখা নেই। নিজের বাক্সটা অবধি নিয়ে গেল না, তাতে অবিশ্যি কাগজপত্র ছাড়া কিছু ছিল না। আমরা আবার আগের মতো শাক-চচ্চড়ি খেতে লাগলাম। রোজ খেতে বসে বাবারা শশীদিদির জন্যে আক্ষেপ করতেন।
তবে জগদীশদাদের বাড়িতে খানিকটা অদলবদল হল। সেই যে পিসিমার ওপর চটে গেল, সেই থেকে জগদীশদার পিসিমার সঙ্গে কথা বন্ধ। রোজ রাত্রে এক টুকরো কাগজে পরদিন কী কী খাবে, তার একটা ফর্দ লিখে পিসিমার দরজায় আলপিন দিয়ে এঁটে রাখত!
শেষটা একদিন সন্ধ্যে বেলায় একগাল হাসি নিয়ে আমাদের বাড়িতে দেখা করতে এল। জেঠিমার তক্তপোশের ওপর কেঠো-কেঠো ঠ্যাং দুটো তুলে বসে বললে, কলকাতায় আমার খুব ভালো চাকরি হয়েছে, আমি কাল সকালের মোটরেই চলে যাচ্ছি। দিন, চাট্টি পায়ের ধুলো দিন। তবে ওই একটা দুঃখ থেকে গেল, গুটেকে হারালাম।
জগদীশদা চলে গেলে আমাদের খুব মন কেমন করছিল। এমন সময় বিকেল বেলায় নেপু বাড়ি এল, মাথা ধরা, পেট ব্যথা আর জ্বর নিয়ে।
নেপুর মাম্পস হল, আমার মাম্পস হল, বড়দার মাম্পস্ হল, শংকর ঠাকুর দেশ থেকে ফেরবামাত্র ওর মাম্পস হল। সব গাল ফুলে চাল কুমড়ো, ইস্কুল যাওয়া, কাজকম্ম, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ।
শুধু আমাদের নয়, শহরসুদ্ধু সকলের মাম্পস হল–পিয়োনদের, পুলিশদের, দোকানদারদের, মাস্টারমশাইদের, এমনকী ডাক্তারবাবুর স্ত্রীর পর্যন্ত মা হল।
ছেলেদের ইস্কুল, মেয়েদের ইস্কুল, পাহাড়তলির প্রাইমারি ইস্কুল সব বন্ধ হয়ে গেল। বোর্ডিঙের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যাদের মাম্পস হয়নি, তাদের সব বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল।
লাবণ্যদি, লতিকাদিও একটা বড়ো দল মেয়ে নিয়ে কলকাতা চলে গেলেন। যাবার আগে আমাকে কত আদর করে গেলেন।
নেপুর অপূর্বদাও গেলেন। যাবার আগে গালফুলো নেপুকে দেখতে এলেন। উনি চলে গেলে পর নেপু বললে, অপূর্বদা আমাকে একটা ভারী কাজ দিয়ে গেছেন। কী, তা বলব না।
আমার তো শুনতে ভারি বয়ে গেছে! এমনিতেই ভীষণ গাল টনটন করছে, খিদে খিদে পাচ্ছে।
১১-১৫. আমরা অসুখ করে
১১.
আমরা অসুখ করে যে-যার বিছানায় পড়ে থাকি। নেপু উঠে মাঝে মাঝে ঘুর ঘুর করে বেড়ায়, তবে ঘর ছেড়ে বার হবার হুকুম নেই। খুব জ্বালায় আমাকে। রাতে আমাদের চোখে ঘুম আসে না। মা জেঠিমারা কতরকম গল্প বলেন, ওঁদের ছেলেবেলার গল্প, ভূতের গল্প, জানোয়ারদের গল্প।
কেমন করে জেঠিমার ঠাকুরদাদা নৌকো করে গঙ্গাসাগরে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছোবার ঠিক আগে কুয়াশায় চারদিক ছেয়ে গেল, তারপর জোর জলঝড় উঠল, নৌকো কোথায় ভেসে গেল তার ঠিক নেই। ভোরে দেখেন একেবারে গহিন সাগরে গিয়ে পড়েছেন। জলের মাঝখানে উঁচু উঁচু দুটো কালো পাথর উঠে রয়েছে। সেই পাথরের ওপর থেকে কী সুন্দর। গান আসছে। মনও কেমন করে, আবার ভয়ও করে শুনলে। মাঝিরা ওঁকে নিয়ে কোনোরকমে নৌকো চালিয়ে এল। ফিরে আবার গঙ্গাসাগরে যখন পৌঁছুল, সবাই বললে বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছ। কিন্তু তার পর থেকে ঠাকুরদাদা কেমন যেন হয়ে গেলেন, আর কোনো সুখ ভোগ ভালো লাগত না তার।
কেমন করে এক সন্ন্যাসীঠাকুর আমার মার দাদামশাইয়ের বাবাকে একটা কালো পাথর দিয়েছিল, বলেছিল তাই দিয়ে যা ছোঁয়াবে তাই সোনা হয়ে যাবে যদি মনে পাপ না থাকে। দাদামশায়ের চোখের সামনে একটা বটফলকে সোনা করে দিয়েও ছিল। কিন্তু সে চলে গেলে পর, আর কিছুকে সোনা করা গেল না। পাপ নেই এমন লোক কোথায় আছে?
বড়োবউদিও বললেন, আমাদের একজন পূর্বপুরুষ একবার ঘোর জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে দেখেন, একজন পরমাসুন্দরী মেয়ে গাছতলায় বসে হাউহাউ করে কাঁদছে। তাকে যত্ন করে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে বাড়ি নিয়ে এলেন, কিন্তু বাড়ি পৌঁছেই মেয়েরা তাকে যেই-না চান করাবার জন্যে শ্বেতপাথরের বাঁধানো চৌবাচ্চায় জলের মধ্যে নামিয়েছে, অমনি সে চিনির মতো গলে গেল! জলের নীচে তার দু-হাতের দুখানি মোটা মোটা সোনার বাউটি থাকল। সে বাউটি এখনও আমাদের দেশের বাড়িতে সিন্দুকে বন্ধ আছে।
আমাদের শংকরঠাকুরও কম্বল মুড়ি দিয়ে, মাথায় মঙ্কি-ক্যাপ পরে দোর গোড়ায় বসে গল্প শুনছিল, সে বললে, আমাদের দেশে সন্ধ্যের পর ওনাদের ভয়ে কেউ পথে বেরুতে চায় না। আমাদের পিস-শাশুড়ি কী যেন মাড়িয়ে, সন্ধ্যে বেলায় পুকুরঘাট থেকে ডুব দিয়ে ভিজে কাপড়ে ফিরছেন, এমন সময় দেখেন কাঁদের যেন ছোটো মেয়ে ঘাটের কাদায় আছাড় খেয়ে পড়ে গেছে।
পিসিমাও অমনি আহা, বাছারে, বলে ছুটে গিয়ে তাকে কোলপাজা করে তুলেছেন, আর অমনি ঝোঁপের আড়াল থেকে সাদা কাপড়-পরা তার মা বেরিয়ে এসেছে। পিসিমা তার কোলে মেয়ে দিয়ে, বাড়ি ফিরে পিদ্দিমের আলোতে অবাক হয়ে দেখেন যে, তার হাতের শাঁখাজোড়া আর আঁচলের চাবিগাছি আগাগোড়া সোনার হয়ে গেছে।