পিসিমা হাউ হাউ করে কেঁদে বললেন, পেলে তো গুরুদেবকেই দিয়ে দিতাম।
নেপু আর আমি সকালে উঠে গিয়ে পড়াশুনা করি, স্নান করে খেয়ে ইস্কুলে যাই, বিকেলে জলখাবার খেয়ে এবাড়ি চলে আসি। সঙ্গে আবার হাতের লেখার খাতা আর পদ্য মুখস্থর বই নিয়ে আসতে হয়।
আমাকে পৌঁছে দিয়ে নেপু অপূর্বর্দার কাছ থেকে একবার ঘুরে আসে। ফিরে এসে, রোজ মিথ্যে করে বলে– অনাথদার কাছে অঙ্ক বোঝাতে গেছলুম; এইসব। কারণ আজকাল অপূর্বদার নাম শুনলেই জগদীশদা রেগে যায়।
আমাদের বাড়িতে শশীকলাদিদিকে নিয়ে খুব গোলমাল চলেছে। তার নাকি আজকাল রোজ চোখে ব্যথা করে। তাই নিয়েই একদিন রাতে জগদীশদার কাছে এল।
পিসিমা রান্নাঘরে, নেপু ফেরেনি, আমি খাটের পায়ের দিকে মাটিতে বসে ভূতপ্রেত পড়ছি, সেদিকে কারো নজর পড়েনি।
শশীকলাদিদি খুব গজগজ করতে লাগল, এবার আমার পাওনা টাকা চুকিয়ে দিয়ে ছুটি দিয়ে দেন, বাবু। নইলে একেবারে রাঁধুনি বামনি বনে যাব।
জগদীশদা এক ধমক দিয়ে বলল, গুটে, খবরদার! তোর পেছনে-না পুলিশ ঘুরছে? বলেছি তো গোলমাল চুকে গেলে তোকে আমার এখানেই চাকরি দেব। ক-দিন চুপ করে থাক, যাবার কথা মুখে আনবি নে!
শশীদিদি বললে, কী চাকরি দেবেন বাবু? আমি পাসকরা গোয়েন্দা, আমি তো আর বাবুর্চি নই।
জগদীশদা চটে গেল, চোপ! তুই একটা থার্ড ক্লাস টিকটিকি কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস বাবুর্চি! যার যেটা কাজ! আর দেখ, ফের যাবার কথা মুখে এনেছিস কি আমি সেই সাইকেলের ব্যাপারটা বলে দেব! তাই শুনে শশীদিদির মুখে আর কথাটি নেই! জগদীশদা আরও কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময়, পড়বি তো পড়, আমার হাত থেকে বইটা ঝুপ করে পড়ে গেল।
দু-জনেই প্রথমে দারুণ চমকে গেছিল, তারপর আমাকে দেখে সে কী রাগ! ভাগ্যিস ঠিক সেই সময় রাঁধাবাড়া সেরে কলতলা থেকে পিসিমা আমাকে ডাকলেন, নইলে আর রক্ষে ছিল না।
শশীদিদি সুড়ুত করে কোথা দিয়ে যে কেটে পড়ল টেরও পেলুম না! ভীষণ রেগে গেছলুম। পরদিন সকালে মাকে সব বলে দিলুম। মা তো রেগে কই!
তুমি তো আচ্ছা মেয়ে শশীকলা! কাজকর্মের নাম নেই, দু-বেলা থালা থালা ভাত ওড়াবে আর দিব্বি পাড়া বেড়াবে! তোমার মাইনে কাটা হবে!
শশীদিদিও মার মুখের ওপর ভীষণ বেয়াদপি করতে লাগল।
যান, আপনারা অন্য লোক দেখুন গে, এত কাজ আমার পোষায় না। একটা গোটা পরিবারের প্রত্যেকটা লোক যে এ-রকম সাংঘাতিক পেটুক হতে পারে এ আমি ভাবতে পারতাম না!
তাই শুনে জেঠিমা বউদি-টউদি সবাই মিলে মহা চেঁচামেচি লাগালেন। তারপর বাবা জ্যাঠামশাইরা বাড়ি ফেরবার আগেই আমাকে শশীদিদির মাইনের হিসেব কষিয়ে, তার হাতে দিয়ে, তাকে বিদেয় করে দেওয়া হল।
আমি বার বার বলতে লাগলুম, ও শশীদিদি, যেখানে-সেখানে ঘুরো না, তোমাকে পুলিশে ধরবে। সটান জগদীশদার কাছে চলে যাও।
শশীদিদির কী দেমাক! চোখ ঘুরিয়ে বললে, সেখানে যেতে আমার বয়ে গেছে। তা আমার জন্যে তোমায় ভাবতে হবে না। একটা চাকরি নাহয় খেয়েই দিয়েছ, জান রাজরাজড়ারা আমাকে লুফে নেবে। কই রাঁধুক তো কেউ আমার মতো হোসেনি কারি! তা যতই লাগানি ভাঙানি করনা কেন!
বলে এক হাত ঘোমটা টেনে বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে গেল!
রাত্রে আমার কাছে সব কথা শুনে জগদীশদা এমনি রাগারাগি করতে লাগল যে, শেষপর্যন্ত নেপু, পিসিমা আর আমি আমাদের বাড়িতে চলে আসতে বাধ্য হলুম!
পরদিন সকালে পিসিমা মা জেঠিমার সঙ্গে সঙ্গে তরকারি কুটতে কুটতে বললেন, আসল কথা তোদের বলাই হয়নি। আমার বাবা ছিলেন লাখপতি, কিন্তু এমনি হাড়কিপটে যে লোকে বলত সকালে ওঁর নাম করলে হাঁড়ি ফাটে। তোরা এখানে ওঁর যে নাম জানিস সেটা ওঁর নাম নয় মোটেই। সেই সব্বনেশে বুড়োর ভয়ে নাম ভাড়িয়ে এখানে এসে ঘাপটি মেরে ছিলেন। এখন পর্যন্ত নাকি লোকে ওঁকে এখানে-ওখানে খুঁজে বেড়াচ্ছে!
সে যাক গে, এখানে বাকি জীবনটা ভগবানের নাম করে কাটিয়ে, শেষটা যখন চোখ বুজলেন, থাকবার মধ্যে রইলাম আমি আর জগদীশের বাবা। আর তাল তাল সোনাদানা আর গোছ গোছ টাকা!
শুনে মা জেঠিমা কুটনো ফেলে গালে হাত দিয়ে বললেন, দেখছ কী কাণ্ড! তা সে সব গেল কোথায়? তোমাদের তো দেখি মাসকাবারে বেশ টানাটানি!
পিসিমা দুঃখু করে বললেন, আরে সে কথা আর বলিস নে! বাবার শ্রাদ্ধের পর কে যে সব চেঁচেপুঁছে নিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। ওই যা দুটো-একটা বাবার পা টেপার সময় বাঁ-হাতে করে সরিয়ে রেখেছিলাম, সে ছাড়া আর কিছু পেলাম না। আমি আর থাকতে না পেরে বললুম, বাঁ-হাতে করে সরানো মানে কী?অমনি মা জেঠিমা চোখ পাকিয়ে উঠলেন, তোর সব কথাতে কী দরকার? যা পড়গে যা!
আমি সরে গিয়ে দরজার ওপাশে বসলাম। পড়া আমার কখন হয়ে গেছে। পিসিমা বলতে লাগলেন, সে এক মজার ব্যাপারে। বাবা বলতেন সিন্দুকের মধ্যে কোনো দামি জিনিস রাখতে হয় না। কারণ চোররা এসে আগেই সিন্দুক ভাঙে, বাক্স খোলে। তাই বাবা করতেন কী, গয়নাগাটি টাকাকড়ি পুটলি বেঁধে চ্যবনপ্রাশের টিনের পেছনে, চ্যাঙারি করে খাটের নীচে, কাগজে মুড়ে যেখানে-সেখানে ফেলে রাখতেন। বাবাও চোখ বুজলেন আর সেসব হাওয়া! ওই দু-চারটে যা আমার কাছে ছিল, তাই-বা রাখতে পারছি কই? জগদীশটা তো অত দামের কৌটো হারাল, হিরের প্রজাপতিটাও খুঁজে পাচ্ছি নে।