ট্যাক্স নেবার বেলায় সব ঠিক আছেন, অথচ নিজের বাড়িতে নিরাপদে ঘুমুতে পারব না, ঠ্যাঙাড়ের দল এসে মেরে পিটিয়ে জিনিস নষ্ট করে দিয়ে চলে যাবে! কেন, থানার লোকেরা করে কী?
কিন্তু জগদীশদা নিজে কিছুই বলতে পারে না। ক-টা লোক, কোন দিক দিয়ে এল, কেমন চেহারা, সঙ্গে হাতিয়ার ছিল কি না কিছুই জানে না!
মা হেসে বললেন, তা জানবে কী করে? সাড়া পেয়েই বোধ হয় স্নানের ঘরে ঢুকেছিল। আমি বললুম, ওমা, না, তাহলে অমন বেদম পিটল কী করে ওকে?
ব্যস্, সবাই মিলে আমাকে সে কী বকুনি! জ্যাঠা মেয়ে, বড়োদের কথায় কথা বলতে আসে, এইসব। চুপ করে সব শুনলুম, কিছু বললুম না।
সন্ধ্যে বেলা পড়ছি, নেপু গেছে তার গুরুঠাকুর অপূর্বদার বাড়ি, কী নাকি জরুরি দরকার! হেসে বাঁচি নে। এমন সময় শশীকল্লাদিদি আস্তে আস্তে দোর গোড়ায় দাঁড়াল।
ও দিদি, সবই তো জানো, এদিকে আমি যে গাল ব্যথায় মলাম। উঃ, দাঁতের গোড়াসুদ্ধ নড়িয়ে দিচ্ছে বোধ হয়! দাও-না, ওই যে কী বড়ি আছে তোমাদের, নইলে আর তো পারছি না!
তাকিয়ে দেখি শশীদিদির গাল ফুলে চালকুমড়ো! বললুম, দেব, যদি বল কে মেরেছে।
শশীকলাদিদি শিউরে উঠে বলল, ও দিদি, দাও দিদি লক্ষ্মীটি, তোমাকে এক্ষুনি গরম পেঁয়াজি খাওয়াব। কুটে রেখে এসেছি ও ঘরে, কড়াইতে তেল ঢেলেছি, দাও দিদি, পায়ে পড়ি!
আমি উঠে বললুম, তা হলে বলবে না? এই আবার বসলুম।
শশীদিদি প্রায় কেঁদে ফেলে, ও কী আবার বসলে কেন? না দিলে যে মরে যাব! বলব কোন সাহসে, ফালা করে চিরে ফেলবে যে! তবু এইটুকু বলছি যে জগদীশবাবুকে রোগা পটকা দেখে মনে কোরো না যে ওনার হাতে জোর নেই!– দাও দিদি দুটো বড়ি!
বড়ি নিয়ে শশীকলাদিদি চলে গেলে পর, নেপু এসে জুতো খুলতে খুলতে বলল, অপূর্বদার খুব জ্বর, সর্দিকাশি। বেরুতে পারছেন না, তাই আমাকে একটা কাজ দিয়েছেন।
আমি কিছুই বিশ্বাস করিনি। মুখে বললুম, কাকে? তোকে? আর হাসতে পারি নে বাবা।
০৯.
অবিশ্যি নেপু কী বলে না বলে আমি থোড়াই কেয়ার করি। তবু এর দু-দিন পরে যখন একদিন বিকেলে জঘন্য নোংরা প্যান্ট-শার্ট পরে এসে, এক ঘণ্টা ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, ভিজে হাত দিয়ে চেপে চেপে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, তুই অপূর্বার যত খুশি নিন্দে করতে পারিস, কিন্তু তোদের নেকি লাবণ্যদিদিমণি দারুণ খাতির করেন। জানিস, ওঁকে এক বোতল পেয়ারা-জেলি পাঠিয়েছেন?
তখন অবাক না হয়ে পারলুম না।
নেপু আমার দিকে না তাকিয়ে, মুখটাকে আয়নার খুব কাছে নিয়ে গিয়ে মাথার মাঝখানকার খাড়া চুলগুলোকে প্লেন করতে করতে বলল, জানিস, অপূর্বদা রোজ সকালে একমনি মুগুর ভাঁজেন! তারপর এক-পো শেকড়ওয়ালা কঁচা ছোলা খান। আমাকেও খেতে বলেছেন, তা তোদের বাড়িতে কি ওসব হবার জো আছে? বলতে-না-বলতে মা তেড়ে আসবেন! জানিস, অপূর্বদা একবার একটা পাগলা মোষের শিং চেপে ধরে, এমনি করে এক মোচড় দিয়ে, তাকে রাস্তার মাঝখানে একেবারে কুপোকাত-এর বেশি আর বলা হল না, কারণ কায়দাটা দেখাতে গিয়ে, নেপুর হাত থেকে চিরুনি ছুটে গিয়ে, জানালার কাছে পড়াতে, কাচ ভেঙে চৌচির আর নেপু জিভ কেটে পগার পার। একা একা কত হাসব?
কিন্তু আজকাল আর খেয়ে-দেয়ে কোনো সুখ নেই, বাবা জ্যাঠামশাইদেরও মন খারাপ! শশীকলাদিদি কেমন যেন বিগড়ে আছে, কখনো বলে দাঁত ব্যথা, বলে পেট কামড়াচ্ছে। মোটে রান্নাঘরের দিকে যায় না। মা জেঠিমাকে আবার হাঁড়ি ঠেলতে হচ্ছে।
সবাই মিলে শশীদিদির কম তোয়াজ করা হয়নি। মুখে গলায় গরম জলের সেঁক, কাগজি লেবু দিয়ে কই মাছের ঝোল-ভাত, হেন-তেন কত কী। আমার যেন বাড়াবাড়ি মনে হয়, কিন্তু আমাদের কথা তো আর তখন কেউ শুনত না।
ও বাড়িতে জগদীশদার শরীর ভালো নেই, তার ওপর সারাক্ষণ গুম হয়ে থাকে। পিসিমা রোজ রোজ এসে বলেন ওঁর নাকি ভয় ভয় করে। শেষটা মাদের বলে-কয়ে, ও বাড়িতে নেপুর আর আমার শোবার ব্যবস্থা করে নিলেন।
বেশ ভালো লাগত। রাতে আমরা ওখানেই খেতুম। পিসিমা নিজের হাতে লুচি, বেগুনভাজা, আলুর দম, ক্ষীর, এইসব করতেন। খাবার সময় ওঁদের ছোটোবেলাকার কত গল্প বলতেন। জগদীশদার বাবা কীরকম দুষ্টু ছিলেন, আর উনি নিজে কী ভালো! ওঁরা নাকি খুব বড়োলোক ছিলেন, পাড়ার লোকের চোখ টাটাত। তারপর জিজ্ঞেস করলেন বোর্ডিঙের মাসিমার টাকাগুলো ফিরিয়ে দিয়েছি কি না? বললুম, মা রাখতে মানা করেছেন, তাই দিয়ে এসেছি। তাই শুনে পিসিমা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আমার বাবার টাকার মতন দেখতে ওগুলো। ওরই মধ্যে পুলিশরা দু-চারদিন এসে জগদীশদাকে দিয়ে সেই রাতের কথা সব লিখিয়ে নিয়ে গেল। নাকি তিন-চারজন দারুণ ষণ্ডা লোক এসে জগদীশবাবুকে চেয়ারের সঙ্গে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেছিল। তবু যখন জগদীশদা বলতে লাগল বাড়িতে আর সোনাদানা কিছু নেই, তখন নাকি রেগেমেগে, চুল টেনে, কান মলে, একাকার করে দিল।
জগদীশদাও ছেড়ে কথা বলেনি। তবে হাত-পা বাঁধা, কী আর করতে পারে, কষে দুকথা শুনিয়ে দিয়েছে। ব্যাটাদের কান লাল হয়ে উঠেছিল।
পুলিশরা চলে গেলে, পিসিমার ওপর জগদীশদার সে কী রাগ! ওর বিশ্বাস ওর ওপর রেগে, পিসিমার গুরুদেব তাঁর শিষ্যদের দিয়ে এইসব করাচ্ছেন। আমাদের সামনেই পিসিমাকে ডেকে বললে, হিরের প্রজাপতি বসানো ঢাকনিটা কোথায় রেখেছ বলোই-না। ভুলে গেছি আবার কীরকম কথা? সমস্ত বাড়ি তচনচ করেও পাওয়া যায় না, ও আবার কীরকম লুকোবার জায়গা?