বিছানায় ফিরে এসে কাউকে কথাটা জানাব কি না ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লুম। সকালে রোজকার মতন শশীকলাদিদিকে ঘোমটা মাথায় ডিম রুটি পরিবেশন করতে দেখে জিজ্ঞেস করলুম, শশীদিদি কাল রাতে কোথায় গেছলে?
শশীকলাদিদি এমনি চমকে উঠল যে ঘোমটা খসে গেল, তখুনি সেটাকে টেনে দিয়ে বললে, রাত দুপুরে আবার যাব কোথায়?
বললুম, কেন, পষ্ট দেখলুম রান্নাঘরে তালা দিয়ে বেরুলে।
শশীদিদি দারুণ চটে গেল, না বাপু! বাড়ির ছেলেপুলেরাও পেছনে লাগলে তো পারা যায়। তা হলে তো কাজ করা দায় হয়ে ওঠে!
অমনি বাবা, জ্যাঠামশাই, নেপু, বড়দা সবাই আমাকে তাড়া!
খবরদার, ওর পেছনে লাগবে না বলছি। না, না, ও ছেলেমানুষ কী দেখতে কী দেখেছে, ওর কথায় কান দিয়ো না।
তারপর শশীকলাদিদির দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে নেপু জিজ্ঞেস করলে, ও কী? মুখে কাপড় জড়িয়েছ কেন? দাঁত ব্যথা নাকি?
শশীদিদিও অমনি ঘাড় নেড়ে বললে যে হ্যাঁ, ভীষণ দাঁত কনকন!
আমি তো হেসে বাঁচি নে, কারণ ঘোমটা খোলার সময় পষ্ট দেখেছিলুম শশীদিদির গালে চড় খাওয়ার পাঁচ আঙুলের দাগ।
চা খাবার পর পিসিমাকে বাড়ি পৌঁছোতে গিয়ে জেঠিমা আর আমি অবাক! দরজা জানলা সব হাট করে খোলা। জিনিসপত্র তচনচ। দেয়ালের ছবি ওলটানো, আলমারির বই মাটিতে, তোশক বালিশ ফালা ফালা। ভাঁড়ারের তালা ভাঙা, শিশি বোতল, বাক্স ভঁড় সব নীচে। বাড়িতে জনমানুষের সাড়া নেই।
এতক্ষণ বাদে পিসিমা ভাড়ার ঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
ওরে জগদীশ, ওরে লক্ষ্মীছাড়া, গুরুদেবকে অশ্রদ্ধা করেছিলি বলেই-না তোর এ দশা হল! ভাঁড়ারের এই অবস্থা আর তুই কি আর আছিস রে!
কিছুতেই থামেন না। জেঠিমা পিঠ থাবড়াতে লাগলেন, আমি একটা পুরোনো খবরের কাগজ দিয়ে হাওয়া করতে লাগলাম। কিন্তু পিসিমা সমানে চাঁচাতে লাগলেন, ওরে হতভাগা! তুই মলে আমার প্রজাপতি কে খুঁজে দেবে বল?
ঠিক সেই সময় সামনের স্নানের ঘরের দরজা খুলে, উশকোখুশকো চুল আর লাল টকটকে চোখ নিয়ে জগদীশদা বেরুল। জামাকাপড় ছেঁড়া, গা-ময় কালশিটে আর আঁচড়কামড়। ভাঙা গলায় বললে, থামো দিকিনি!
পিসিমাও অমনি হাত-পা এলিয়ে ভিরমি!
সেই সময় লাবণ্যদি আর লতিকাদি এসে না পড়লে কী মুশকিলেই যে পড়া যেত! জগদীশদা ওঁদের দেখে এক দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে ছিটকিনি!
শেষটা লাবণ্যদিরা ধরাধরি করে পিসিমাকে খাটে শুইয়ে মাথায় ঘড়া ঘড়া জল ঢাললেন, তবে পিসিমা চোখ মেলে চাইলেন।
চেয়েই বললেন, বিছানা ভেজালে, এখন শুকুবে কী করে শুনি?
লতিকাদি শুনবেন কেন, বললেন, জল ঢালব না তো কী, আরেকটু হলেই যে চোখ উলটে গেছিল! বলে নিজেরাই হাতে হাতে ভঁড়ার ঘর গুছুতে লেগে গেলেন। আমাকে বললেন, ছোকরা চাকরটা গেল কোথায়, গুদোমে গিয়ে খোঁজ নে।
দেখি সে এইমাত্র কোত্থেকে যেন ফিরে, চকচকে পামশু খুলে রেখে, পা ধুচ্ছে। বলল নাকি অপূর্বদা ওকে কাল রাত নটার বাইস্কোপে পাস দিয়েছিলেন, ম্যানেজার ওর দোস্ত কি না। রাতে আর ফেরেনি, কোন বন্ধুর বাড়িতে খেয়েদেয়ে শুয়ে ছিল। এ বাড়ির রাঁধাবাড়ার তো কিছু ঠিক নেই। কাল দুপুরেও দোকানে গিয়ে তেলেভাজা দিয়ে মুড়ি দিয়ে খেয়ে আসতে হয়েছিল। এখানে আর বেশিদিন ওর কাজ করার ইচ্ছে নেই। আরও কী কী যেন বলতে যাচ্ছিল, লাবণ্যদিরা ডাকাডাকি করাতে আর বলা হল না।
ওর হাতে চিঠি লিখে লাবণ্যদিই থানায় পাঠালেন। জগদীশদা অনেক ডাকাডাকি করাতেও ঘরের দোর খুলল না। শেষটা জেঠিমা পিসিমার কাছে থাকলেন, লাবণ্যদিদিদের সঙ্গে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছিল না।
ততক্ষণে পিসিমা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছেন। এঁটে খোঁপা বেঁধে লাবণ্যদিদিদের বললেন, একটু দাঁড়িয়ে যাও বাছা। আমার জন্যে অনেক করলে, দু-জনায় এই শিশি দুটো নিয়ে যাও দিকিনি। ধরো লতিকা, লেবুর ঝাল আচার। ওটা সামান্য একটু গেঁজে গেছে, কিন্তু দু-দিন
রোদ্দুরে দিয়ে নিলেই কেউ টেরও পাবে না। আর লাবণ্য, তুমি বাছা এই পেয়ারার জেলিটা নিয়ে যাও। কালো দেখে মনে কোরো না যে খেতে খারাপ খারাপ জিনিস আমার হাতে বেরোই না কখনো, তবে ওই একটু কালচিটে রং ধরে গেছে। এ কি আর আমি সহজে হাতছাড়া করি, নেহাত কোন অজাতে-বেজাতে ছুঁয়ে দিয়েছে, তার কোনো ব্যামোটামো ছিল কিনা তাই-বা কে জানে। আচ্ছা বাছা, এসো তা হলে, আমার এই বেলা অবধি জপ সন্ধ্যে কিছুই হল না।
এই বলে আমাদের সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। আমাকে কিন্তু কিছু দিলেন না। অথচ লেবুর আচার, পেয়ারা-জেলি আমিও যথেষ্ট ভালোবাসি।
বাড়ির বাইরে এসেই দেখি শীতের রোদ্দুরে সারা শহরটা ঝিমঝিম করছে। দূরে মাথার ওপর ঘন নীল আকাশে দুটো চিল ঘুরছে। ঝাউ গাছের পাতা বাতাসে দুলছে, কোত্থেকে যেন কমলা লেবুর গন্ধ আসছে। কে বলবে জগদীশদাদের বাড়ির মধ্যে এত কাণ্ড!
আমাদের চান-খাওয়া সারা হয়ে যাবার কত পরে জেঠিমা ফিরলেন। মা আর অরুণাবউদি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, খিদেও পেয়েছিল বোধ হয়, ওঁদের আবার চান করে উঠেই না খেলেই নয়! জেঠিমা এসে ঢুকতেই দু-জনে কী হল, কী হল করে হামলে পড়লেন।
জেঠিমা মাথায় দু-ঘটি জল ঢেলে, একসঙ্গে খেতে বসে বললেন, সে এক কাণ্ড, বুঝলি মেজোবউ, বাড়িঘর ডালের কাঠি দিয়ে নাড়া, অথচ ঠাকুরঝি বলে কী, না কিছু হারায়নি। আবার হারায়নি বলে রাগ কত! বলে কি না, কই করুক তো কেউ আমার মতো জ্যাম জেলি, অথচ একটা ছোটো শিশি অবধি নিল না! কেন, আমার জিনিস খারাপ নাকি? নাকি, তোরাই ভালো জিনিস দেখলে চিনিস না? চুরি করতে এইচিস অথচ কোনটা ভালো কোনটা মন্দ জানিস না! এ আবার কেমনধারা চোর! শেষটা পুলিশ ইন্সপেক্টর লোকজন নিয়ে এসে পড়াতে পিসিমাকেও থামতে হল, আর জগদীশদাকেও বেরিয়ে আসতে হল। বেরিয়েই পুলিশদের ওপর রাগমাগ করতে লাগল।