আমি বললুম, হ্যাঁ, সে আমি তোমায় বলি আর তুমি গিয়ে কাপ্তান অপূর্বর কাছে লাগাও আর কী!
নেপু অঙ্কটঙ্কর কথা ভুলে গেল।
অপূর্বদার বিষয় তুই কী জানিস শুনি? জানিস ইন্টার-কলেজিয়েট সাঁতারের জন্যে উনি মেডেল পেয়েছিলেন? তা ছাড়া ভাগ্যিস ওঁর দল রাতে পাড়ায় পাড়ায় টহল দেয়, তাই চোরবাছাধনরা আর টু শব্দটি করতে পারছেন না!
বললুম, রেখে দাও!ওঁর নাকের সামনে আমাদের ইস্কুলে অমন কাণ্ড হয়ে গেল, ভারি আমার ওস্তাদ রে!
নেপু তাই শুনে একটু মুচকি হেসে বললে, সে বিষয়ও কিছু এগোয়নি ভেবেছিস নাকি তোরা? শিগগির একদিন সব চোখ ট্যারা হয়ে যাবে দেখিস!
এমনি সময় শশীকলাদিদি দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলল, গরম গরম চপ ভেজেছি, খাবে নাকি দু-একটা?
এরপর তো আর কোনো কথাই হতে পারে না।
ওসব ছোটো জায়গায় সেকালে কারো ঘরের কথা কারো জানতে বাকি থাকত না। দু-দিনেই একথা জানাজানি হয়ে গেল যে জগদীশদার সঙ্গে অপূর্বদার কিছু নিয়ে মন কষাকষি চলেছে।
সত্যি আগে দেখতুম দু-জনায় ভারি ভাব, কিন্তু আজকাল দেখা হলেই আমাদের কাছে জগদীশদা অপূর্বর্দার খুব নিন্দেমান্দা করতে শুরু করল। প্রথমটা বেশ মজা লাগত।
পরে নেপুকে গিয়ে বলতুম আর সে তো রেগে টং!
ওই স্টুপিডটাকে এ-বাড়িতে আসতে দিস কেন রে? যার নিজের পকেট থেকে নিজেদের সোনার কৌটো চুরি যায়, অথচ নিজে টের পায় না, সে আবার একটা মানুষ নাকি? অপূর্বার সঙ্গে ও ব্যাটার তুলনা! কীসে আর কীসে, সোনায় আর সিসেয়! কই অপূর্বদা তো জগদীশদার বিষয় কিছু বলতে আসেন না!
শশীকলাদিদি যে কখন এসে আমাদের পেছনে দাঁড়িয়েছে সে আমরা টের পাইনি। সে বললে, তা সে বলবে কেন? একটা ধর্ম আছে তো? জগদীশবাবুর কাছে রাশি রাশি ঘুস খেয়েছে-না!
নেপু বললে, কী আবার ঘুস খেয়েছে?
শশীকলাদিদি জিভ কেটে বললে, না, না, ও কিছু না। বলে তাড়াতাড়ি সরে পড়ল।
এবার আর মাসিমার ওই টাকাগুলোর কথা নেপুকে না বলে পারলুম না। নেপু তো হাঁ!
কই, দেখা তো টাকাগুলো?
আস্তে আস্তে বইয়ের তাকের কাছে গিয়ে দেখি তাক তোলপাড় করে কে খোঁজাখুঁজি করেছে!
নেপু বললে সর্বনাশ! তবে তো সেগুলোও গেছে! না হেসে পারলুম না। তাকের তলা থেকে আমার পুরোনো জুতোটা টেনে বের করে তার মধ্যে থেকে টাকা বের করে নেপুকে দেখালুম।
নেপু ওগুলোকে নেড়েচেড়ে বললে, এখন এর এক-একটার দাম হয়তো পঁচিশ টাকা। সাধে মাসিমা কাছে রাখতে ভয় পান। দে আমাকে, অপূর্বার কাছে রেখে দিই, কারো বাবাঠাকুর টেরটি পাবে না!
দিলুম না কিছুতেই।
ওদিকে জগদীশদাদের বাড়িতেও মহা গোলমাল। পিসিমার গুরুদেব কায়েমি হয়ে বসেছেন। এমনিতে পিসিমার মুখের ওপর কিছু বলতে জগদীশদা সাহস পায় না, এবার কিন্তু দারুণ একচোট ঝগড়া হয়ে গেল! জগদীশদা বললে, দ্যাখো, তোমার গুরুদেবকে এবার কাশীবাসী হতে বলল, নইলে ভালো হবে না। একবার শ্রীঘর ঘুরে তো যথেষ্ট চেঞ্জ হয়েছে, আবার এখানে কেন? তা ছাড়া সন্নিসি মানুষের অত কী রে বাবা! রোজ রোজ গাওয়া ঘি, খ্যাসরাপাতি চালের ভাত, ছানার বড়া! কই আমাকে তো এর সিকির সিকিও দাও না! অথচ খালি খালি বলল, টাকা দাও, টাকা দাও। বলি, তোমার গুরুদেবকে পুষবার জন্যে তো আর আমি আপিসে চাকরি করি না!
পিসিমাও রুখে উঠলেন, ওরে হতভাগা! গুরুদেব শিবের মাথায় বেলপাতা দিলেন, তবে-না চাকরি পেলি! আবার বড়াই! যা আছে তোর সব-ই তো গুরুদেবের দয়াতে।
জগদীশদা বললে, ইস্, তা তো বটেই! এই বাড়ি আমার ঠাকুরদা দেননি আমাকে? গয়নাগাটি, টাকাকড়ি সবই আমার হত, তুমি যদি মাঝখান থেকে সেগুলো মেরে না দিতে! যাক গে, ওকে এখন ভালোয় ভালোয় কেটে পড়তে বলো দিকিনি।
চ্যাঁচামেচি শুনে গুরুদেবও এসে হাজির! রাগের চোটে মুখের রং পাকা আম, চুলদাড়ি খাড়া। চেঁচিয়ে বললেন, তাই কেটিয়ে যাবে রে। তখন তোর কী অবস্থা হয় দেখিয়ে দেব। দে বেটি, কৌটোর সে পতাঙ্গটো দে, লিয়ে যাই।
পিসিমা গুরুদেবের পায়ে পড়ে বললেন, আর দুটো দিন সময় দেবেন ঠাকুর, কোথাও খুঁজে পাচ্ছি নে যে।
জগদীশদা তো থ!
খবরদার পিসিমা, বুড়োকে এ-বাড়ি থেকে কোনো জিনিস দিতে পারবে না।
পরে পিসিমা জেঠিমাকে বলেছিলেন যে জগদীশদার যে আবার এত তেজ এ তার ধারণার বাইরে ছিল। বললেন, কী বলব তোদের, ওকে দেখে নেকড়ে বাঘের কথা মনে হচ্ছিল। গুরুদেব বেচারা আর কথাটি না বলে, পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে রওনা! একটু টিপিন পর্যন্ত দিতে পারলাম; মাঝের ঘরে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙিয়ে জগদীশ বললে, একটা সটির দানা পর্যন্ত দেবে না! উঃ! রাঁধিনি, খাইনি, পেট জ্বলে গেল! ফলপাকুড় কিছু থাকে তো দে।
মা সন্দেশ আর পাকা কলা এনে দিয়ে বললেন, জগদীশ কী খেল?
পিসিমা বললেন, ও ব্যাটার কথা আর বলিস না। প্রফুল্ল কেবিন থেকে একরাশ গিলে এল। ভাবছি আজ তোদের এখানেই শোব!
০৮.
সত্যি সত্যি রাতটা পিসিমা থেকে গেলেন। শুলেন আবার আমার খাটে। সারারাত ঘুমুব কী? খালি খালি ঠান্ডা খড়খড়ে পা দুটো আমার লেপের মধ্যে গুঁজে দিয়ে গরম করতে চেষ্টা করতে লাগলেন।
হঠাৎ কড়াৎ করে ছিটকিনি খোলার শব্দ শুনে উঠে বসলুম। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি শশীকলাদিদি, টর্চ হাতে নিয়ে, রান্নাঘরের দোরে তালা লাগিয়ে খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে গেল।