নেপু দিস্তে দিস্তে হলদে কাগজ কিনে এনে, এক ভাঁড় ময়দার লেই বানিয়ে খাতার মলাট দিতে লেগে গেল। অথচ পড়াশুনো করবে কচু!
চুরিটুরি গুলোও কমতে কমতে একরকম বন্ধই হয়ে গেল। যাদের ধরা হয়েছিল, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই কোনোরকম প্রমাণ না পাওয়াতে বেশিরভাগই ছাড়া পেয়ে গেল। দেখলুম দিব্যি চেকনাই শরীর করে সব দলে দলে বেরিয়ে এলেন।
বিকেলে জগদীশদার পিসিমা আমাদের বাড়িতে এলেন।
দ্যাখ দিকিনি কাণ্ডটা! গুরুদেব সেখান থেকে আধখানা হয়ে এলেন, তবু তার কাছে সব কথা খুলেই বলে ফেললাম। শুনে বললেন, কৌটো গেছে আবার পাওয়া যাবে, কিন্তু হিরের প্রজাপতি দেয়া ঢাকনিটে হাতছাড়া করার কোনো মানেই হয় না, ওটি ওঁর চরণে জিম্মা করে দিলে আর কারো বাবার সাধ্যি থাকবে না খুঁজে বের করে।
কিন্তু সে যে কোথায় লুকিয়ে রেখেছি কিছুতেই মনে করতে পাচ্ছিনে। গোটা বাড়িটাকে ওলটপালট করে ফেললাম, তবু পেলাম না! কী করা যায় বল দিকিনি? ওটি এখন চুরি গেলেও তো টের পাব না! গুটেকে কেন যে তাড়ালাম! সে থাকলে ছোঁকছোঁক করে ঠিক বের করে দিত!
মা জেঠিমা এ ওর মুখের দিকে তাকালেন, মা একটু আমতা আমতা করে অন্য কথা পাড়লেন, আচ্ছা, ঠাকুরঝি, সেদিন মাসিমার হাতে পুরোনো টাকা দেখে অমন করে ছুটে চলে গেলে কেন, সে তো বললে না?
পিসিমা দু-চোখ কপালে তুলে বললেন, ওমা বলিনি বুঝি? দ্যা দিকি কাণ্ড। তবে শোন, আমার বাবা চোখ বুজলে, শ্রাদ্ধশান্তির আগের দিন, ওঁর খাটের তলা থেকে বিরাট এক লোহার ট্রাঙ্ক বেরুল, এমন ভারী যে একা আমি সহজে নাড়াতে পারি নে!
একদম কানায় কানায় এই বড়ো বড়ো ভারী ভারী রুপোর টাকায় ঠাসা, একেবারে অবিকল বোর্ডিঙের মাসিমার ওই টাকার মতন! তখন আর সময় ছিল না, কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে এক মুঠো তুলে ভালো করে দেখবার জন্যে আঁচলে বেঁধে ফেলে বাকি আবার বন্ধ করে ফেললাম। সে কি বন্ধ হয়! বাক্সের ডালায় চেপে বসে তবে বন্ধ করতে হল! অথচ শ্রাদ্ধশান্তির পর ডালা খুলে দেখা গেল কেবল ছেঁড়া কাগজ আর পুরোনো বই দিয়ে ঠাসা!
জেঠিমা বললেন, ওমা! অত সব নিলে কে?
পিসিমা প্রায় কেঁদেই ফেলেন, কে নিল বুঝবে কে? এমনকী, যখন টাকার কথা বললাম কেউ বিশ্বাসই করে না। বলে হ্যাঁ, এর বাড়ি ওর বাড়ি খেয়ে বেড়াত, ওর আবার অত টাকা আসবে কোত্থেকে?
পিসিমা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। মা বললেন, তারপর মাসিমার হাতে ও টাকা দেখে বুঝি ভাবলে যে তোমার গুলোই কেউ সরিয়েছে? বাড়ি গিয়ে কী দেখলে?
পিসিমা বললেন, দেখলাম আমার পঁচিশটে টাকা ঠিকই আছে। অথচ এগুলোও সেইরকমই দেখতে বটে! কী জানি, কত কী মনে হচ্ছে!
শশীকলাদিদি এতক্ষণ দোরগোড়া থেকে সব শুনছিল, কেউ টের পায়নি। এবার একটা ছোটো নোটবই আর কপিং পেনসিল বের করে বলে উঠল, আচ্ছা, আপনার বাবা মারা যাবার সময় বাড়িতে কে কে ছিল?
পিসিমা বললেন, তোমার তাতে কী, বাছা? তবে বলতে কোনো বাধা নেই, বাড়িতে ছিল না বিশেষ কেউ, বুড়ো কি আর কাকেও চটাতে বাকি রেখেছিল! ছিলাম আমি, আর জগদীশের বাবা ঘেঁটু আর আমার অধরা, তার মেয়ে রেবতী আর আমাদের চাকর রামভজন। তাদের কাকেও সন্দেহ করা যায় না, পুরোনো লোক, নিকট আত্মীয়, বিশ-পঁচিশ বছরের সব জানা। তা ছাড়া তাদের বাক্স প্যাটরা খুলিয়ে নিজে দেখেছিলাম, তাইতেই তো সকলের সঙ্গে চিরকালের ছাড়াছাড়ি!– ও কী শশীকলা, আমার সব কথা টুকে রাখছ কেন? না মেজোবউ, বড়োবউ, এ আমি ভালো বুঝি নে!
শশীকলাদিদি লজ্জা পেয়ে বললে, না, মানে, বাবু আমাদের সবাকার নাম লিখিয়েছেন কি না, তাই সময় পেলেই একটু চেষ্টাচরিত্তির করি।
জেঠিমা শুকনো গলায় বললেন, সময় কোথায় পেলে বাছা?
শশীকলাদিদি আর দাঁড়াল না।
পিসিমা চলে গেলে পর জেঠিমা রান্নাঘরে গিয়ে শশীকলাদিদিকে আচ্ছা করে বকে দিলেন।
মেয়েমানুষের অত কী বাপু? বলছি না টিকটিকির কাজ আমরা করব, তুমি রাঁধাবাড়া নিয়ে থাকবে। বেলা এগারোটা থেকে চারটে অবধি বাড়ির বাইরে তুমি যা ইচ্ছে করতে পার, তার ওপর আমাদের হাত নেই কিন্তু এখন তুমি আমাদের রাঁধুনি– দাও শিগগির খাতা!
বলে খাতাখানা টেনে নেন আর কী! শশীদিদিও কিছুতেই দেবে না, উলটে মহা হউমাউ লাগল! তাই শুনে বাবা জ্যাঠামশাই ছুটে এলেন, আহা, করো কী করো কী, অ্যাদ্দিন বাদে চাট্টি ভালো-মন্দ খেয়ে বাঁচছি, তা তুমি দেখছি সব পণ্ড করে দেবে! না, না, তোমার খাতা দিতে হবে না, এখন যাও দিকিনি রান্নাঘরের দিকে, আপগানি কাটলেট করবে বলেছিলে না?
বাস্তবিক শশীকলাদিদির সে রান্নার স্বাদ আজও আমার মুখে লেগে রয়েছে। কাজেই নেপু, আমি, বড়দা ইত্যাদি সবাই ওর ওপর মহাখুশি ছিলাম।
সন্ধ্যে বেলা পড়ার ঘরে অঙ্ক কষছি, এমন সময় শশীকলাদি এসে হাজির!
ও দিদি, বলোই-না সে টাকা দেখেছিলে নাকি?
আমি নেপুর দিকে তাকিয়ে বললুম, কোন টাকা?
সে বললে– ওই যে বুড়ো মলে পব বাক্স থেকে উধাও হল, তারপর বোর্ডিঙের বড়ো মাসিমা ঠিক সেইরকম দেখতে টাকা তোমার কাছে রাখতে দিলেন? দেখি-না একবারটি।
নেপু রেগে গেল, আঃ শশীকলাদিদি, তুমি দেখছি আমাকে কাল বকুনি খাওয়াবে। এমনিতেই অঙ্ক হয় না।
সে চলে গেলে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কোন টাকা রে?