আমার জেঠিমা উঠে এসে লণ্ঠনটা তুলে ধরে মুখ দেখতে লাগলেন। চোখে আলো পড়াতে সে লোকটা চোখ পিটপিট করতে লাগল।
আমি অবাক হয়ে বললুম, ইয়ার্কি পেয়েছ জগদীশদা? এই তোমাদের সেই চোরের সর্দার গুটে না?
জেঠিমা চমকে উঠে আরেকটু হলেই লণ্ঠনটা ফেলে দিচ্ছিলেন। জগদীশদা আমাকে এক ধমক, তুই থাম দিকিনি। যত বড়ো মুখ নয় তত বড় কথা!
গুটেও বিরক্ত হয়ে বলল, অত তেজ কীসের তোমার, দিদি? জানো আমি ম্যাট্রিক পাশ? গোয়েন্দাগিরির সার্টিফিকেট আছে আমার। ট্যাক্স দিই।
জেঠিমা বাধা দিলেন, আচ্ছা আচ্ছা ঢের হয়েছে, করবে তো রাঁধুনিগিরি, তা অত সার্টিফিকেট দিয়ে কী হবে? দেখো, তোমাকে আমি রাখতে পারি ওই মাইনেতে, কিন্তু তাহলে তুমি খালি মন দিয়ে রাঁধাবাড়া করবে। গোয়েন্দাগিরি যা করবার আমরা করব, আমাদের সার্টিফিকেট না থাকতে পারে, কিন্তু খাতায় নাম লেখা আছে। বুঝলে।
বাবুরা বাজার করে দেবে, আমি দু-বেলার ভাড়ার বের করে দেব, মেজোবউ কুটনো কুটে দেবে, আর তুমি কী রাঁধাবাড়া হবে সব নিজে ঠিক করে, মশলা বেটে, দু-বেলা রাঁধবে, ব্য। তোমার পেছনে আমরা ম্যাও ধরে বেড়াতে পারব না বলে রাখলাম। এবার একটু তদন্ত করবার তাহলে ফুরসত পাব।
গুটে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, গোয়েন্দাগিরিটাই হল গিয়ে আমার পেশা, মাঠাকরুন, সেটাই ছেড়ে দিলে যে একেবারে রাঁধুনে বামুন বনে যাব।
জেঠিমা আশ্চর্য হয়ে বললেন, মাইনে নিয়ে, দু-বেলা পেটপুজো করে, লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করবে আর রাঁধুনে বনবে না, সেটা কী করে হয় বাছা? আমার কথা ভালো না লাগে তো অন্য জায়গায় চেষ্টা করতে পার। তবে পুলিশে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেটা মনে রেখো।
গুটে একটু রেগে গেল, যা হয় একটা বললেই হল কিনা মাঠাকরুণ! পিসিমার কথায় আমাকে যদি পুলিশে ধরে তো ক্ষতি হবে কার?
গুটে আরও কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ততক্ষণে জগদীশদা গিয়ে বাবা আর জ্যাঠামশাইকে ধরে এনেছে। তারাও চপ কাটলেট মুর্গ-মসল্লামের নাম শুনে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, গুটেকে রাখা হোক। জগদীশ ওকে ক-দিন খাটের তলায় লুকিয়ে রাখতে পারে? না হে গুটে, তুমি এখন থেকেই কাজে বহাল হলে। বাপ! পনেরো বচ্ছর ধরে রোজ দু-বেলা শাক-চচ্চড়ি আর মাছের ঝোল খেয়ে খেয়ে খাওয়ায় ঘেন্না ধরে গেছে-না! তা, কাল সকালে কী রাঁধছ বলো!
এই নিয়ে মহা একটা শোরগোল হয়েছিল। শেষ অবধি জ্যাঠামশাই বললেন যে, আমাদের বাড়ির মধ্যে গুটে গোয়েন্দাগিরি করবে না। কিন্তু রোজ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে রাঁধাবাড়া সেরে ঢাকাটুকি দিয়ে চলে যাবে। আবার সাড়ে দশটায় জ্যাঠামশাই শুতে যান, তার মধ্যে ফিরে আসা চাই। তাই শুনে গুটে মহা কাওম্যাও লাগাল, ও বাবা! রাতে আমি বেরুতে পারব না, আমার ভূতের ভয় করে!
জেঠিমা দারুণ চটে গেলেন। নবাব! চাকরের কাজ করবেন, তার আবার ভূতের ভয়! ওসব বড়োমানুষি এখানে চলবে না বলে রাখলুম!
কিন্তু যে যাই বলুক মুর্গ-মসল্লামের কথা শুনে অবধি, বাবা জ্যাঠামশাই গুটেকে ছাড়তে রাজি নন। বাবা বললেন, বেশ, তা হলে রোজ বেলা এগারোটার মধ্যে রান্না সেরে বেরিয়ে যাবে, চারটের সময় ফিরে এসে চায়ের জল চাপাবে।
বলেই বাবা একটু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, হারে, দিনে বেরুলে তোকে পুলিশে ধরবে না?
গুটে সলজ্জ হেসে বললে, না স্যার, আমি লেডি সেজে থাকব। এর মধ্যে দু-দিন ও-রকম সেজে ইন্সপেক্টর বাবুর বাড়ি গিয়ে লেবু বেচে ওনাদের পরখ করে এসেছি। তবে আপনারা কিন্তু আমাকে শশীকলা বলে ডাকবেন। তাতে কোনো দোষ হবে না। শশীকলা হল গিয়ে আমার স্ত্রীর নাম, সে দেশে থাকে, জানতেও পারবে না। আপনাদের কোনো ভয় নেই, কাল সকালের মধ্যে দাড়ি চেঁচে শাড়ি পরে কেমন কাজে লেগে যাই দেখবেন।
যাবার আগে জগদীশদা বাবাকে বলল, দেখবেন মামা, ওটি একটি রত্ন। আপনার ঠাকুর ফিরে এলেও ওকে আপনার ছাড়তে ইচ্ছে করবে না। তখন কিন্তু আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে বলে রাখলাম। ততদিনে আশা করছি এদিককার গোলযোগ চুকেবুকে যাবে।
গুটে কিন্তু খুব আপত্তি করতে লাগল, ও আবার কী কথা, স্যার? গোলযোগ চুকে গেলেও আমাকে এ-রকম চাকরি করতে হবে নাকি? আমি হলাম গিয়ে গোয়েন্দা, অন্য কোথাও তদন্ত করতে চলে যাব।
জগদীশদা বিরক্ত হয়ে বললে, রাখো! তোমার তদন্তের চাইতে তোমার রান্না শতগুণে ভালো।
তারপর বাবাকে বললে, মামা, বড়ো উপকার করলেন, তার পুরস্কার হাতে হাতে ওই গুটের হাতেই পেয়ে যাবেন রোজ দু-বেলা!
০৭.
এমনি করে শশীকলাদিদি আমাদের বাড়িতে এসে জুটলেন। মা-বাবা, জ্যাঠামশাই, জেঠিমা, জগদীশদাদা আর আমি ছাড়া কেউ আসল ব্যাপারটা জানল না, নেপুও না। ওকে বলা মানেই অপূর্বদাকে বলা, তার মানেই খবরের কাগজে ছেপে দৈওয়া।
তবে একথা সত্যি শশীকলাদিদি খাসা রাঁধে। প্রথম দিনটা মা-জেঠিমা একটু খেইমেই করেছিলেন, বড় ঘি খরচ করে, ওঁরা রান্নাঘরে গেলে তেড়িয়া হয়ে ওঠে ইত্যাদি। কিন্তু একবার রান্না খেয়ে আর টু শব্দটি করলেন না। একমনে এর ওর বাক্স সার্চ করতে লাগলেন।
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। আমাদের সকলের ইস্কুল-টিস্কুল কবে খুলে গেল, নতুন বছরের পড়াশুনো শুরু হয়ে গেল, গোছ গোছা সব নতুন বই খাতা এল। কী সুন্দর যে তাদের গন্ধ, নাক লাগিয়ে পড়ে থাকতে ইচ্ছে করত।