বড়ো মাসিমা তবু বলতে লাগলেন, বুড়ো চোখ বুজলে পর কাউকে ভালো করে ফলার করাল না পর্যন্ত। কোত্থেকে ওই জগদীশটাকে আনাল, শুনি নাকি ওর ভাইপো! কী জানি বাছা, কে যে চোর আর কে যে সাধু বুঝিনে।
মা আরও ব্যস্ত হলেন, দেখুন ওঁরা সত্যি ভালো লোক। কেবল যখন সাজঘরে অমন কাণ্ড হচ্ছিল, আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম জগদীশ আর তার পিসিমা, আমার সামনে বসে জায়গা নিয়ে মহা খ্যাচাখেচি করছে! বিশ্বাস করুন ওঁরা এর মধ্যে নেই।
বড়ো মাসিমা উঠে বলেন, যাই, আমার আবার সন্ধ্যে বেলায় ডিউটি আছে।
দরজা অবধি গিয়ে আবার ফিরে এলেন।
ভাই, এই সন্ধ্যে বেলায় এখন আমার একটি একাটি টাকাগুলো নিয়ে যেতে ভয় করছে, তুমি বরং রেখে দাও।
মা যেন ঘাবড়াচ্ছেন দেখে, আমি বড়ো মাসিমার হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে আমার বইয়ের তাকে, বইয়ের পেছনে গুঁজে রেখে দিলুম।
বড়ো মাসিমা খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলেন।
০৬-১০. এসব এতদিন আগের কথা
০৬.
এসব এতদিন আগের কথা যে ঘটনাগুলো কোনটা আগে কোনটা পরে ঠিক মনে নেই, তবে ওই একটা গোটা বছর আমার জীবনে আর সব বছর থেকে একেবারে আলাদা, এ-বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই।
মনে আছে সে বছরটা খাওয়া-দাওয়া বেড়ানো-বুড়োনো এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। সকলের মুখে সর্বদা ওই এক কথা, কে জানলায় লোহার শিক বসালে, কে লোহার সিন্দুক কিনল, সেটা কোথায় রাখা হল, কার গয়নাগাটি ব্যাঙ্কে জমা হল, কে সেসব সেখানে পৌঁছে দিল– এইসব।
নেপু বলত, বাঃ, চোরদের তো ভারি সুবিধে হয়ে গেছে, একটু কানখাড়া করে থাকলেই হল, সব খবর পেয়ে যাবে। কার কার কুকুর আছে, তাদের মধ্যে কারা কামড়ায়? কার ঘরে বন্দুক আছে, কে কে সেসব ছুঁড়তে জানে কিছুই কারো জানতে বাকি থাকল না।
ওই ঘটনার পর যেই পিসিমা সন্ধ্যে বেলায় আলোয়ান মুড়ি দিয়ে আমাদের বারান্দায় উঠেছেন, মা আর জেঠিমা ওঁকে জেরা করতে লেগে গেলেন। ততক্ষণে পিসিমারও রাগ পড়ে গেছে, অনেক কথার উত্তর দিলেন। সবাই সেসব শুনতে এমনি মেতে গেল যে, মাছওয়ালি বুড়ি এক চুবড়ি বিকেলে-ধরা পাহাড়ে কইমাছ নিয়ে এসে ডেকে ডেকে, সাড়া না পেয়ে ফিরেই যাচ্ছিল। ভাগ্যিস আমি বুদ্ধি করে জ্যাঠামশাইকে বললুম, নাহলে সেদিন মাছ খাওয়া হয়েছিল আর কী!
পিসিমারা তো গিয়ে জেঠিমার শোবার ঘরে ঢুকলেন। আমিও একটু পরে সেখানে গিয়ে শুনি মা বলছেন, যাই বল ঠাকুরঝি, ওই বুড়োর নাতি-নাতনিরা কে কোথায় আছে খোঁজ করা উচিত।
জেঠিমা বললেন, আর তাই যদি হয় যে সোনার নস্যির কৌটো উদ্ধার করা ওদের উদ্দেশ্য, তবে সে তো হয়েই গেছে, তবু চুরি থামে না কেন?
পিসিমা জেঠিমার খাটের ওপর পা গুটিয়ে বসে বললেন, তোরা কিছুই জানিস না নাকি? জুয়ো খেলায় আর চুরি করাতে, যতই সফল হওয়া যায় ততই নেশা লেগে যায়।
মারা চুপ করে থাকছেন দেখে আবার বললেন, তাহলে তোদের সত্যি কথাটাই খুলে বলি। তোরা যেন আবার পাঁচকান করিস নে।
কৌটো নাহয় চুরি গেছে কিন্তু তার ঢাকনিটা আছে তো? এই এত বড়ো হিরের প্রজাপতি বসানো ঢাকনিটাই তো আসল। সেটি তো আর ওরা পায়নি। আমার তো মনে হয় সেটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে, এ আর কিছু নয়।
মা অবাক হয়ে বললেন, সেটি বুঝি ব্যাঙ্কে পাঠাওনি? পিসিমাকে যেন বিরক্ত মনে হল।
আরে তবে বলছি কী, খুঁজে পেলে তো পাঠাব। সে যে কোথায় রেখেছি সে আর কিছুতেই মনে করতে পাচ্ছি নে।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, চোররা পাবে কি, আমিই পাচ্ছি না!
জেঠিমা বললেন, এই যদি ব্যাপার হয় তো গুটেকে সন্দেহ করা কেন?
মা-ও আর থাকতে না পেরে আসল কথাটাই বলে বসলেন, আর পরশু বোর্ডিঙের মাসিমার টাকাগুলো দেখে অমন করে চলে গেলে কেন?
পিসিমা অমনি টুক করে খাট থেকে নেমে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, ওমা, বাগানে এই শীতের মধ্যে ও আবার কীসের চারা গজিয়েছে রে? যাই, একবার দেখেই আসি।
এই বলে বাগান দেখার নাম করে সেখান থেকে দে পিটান।
জেঠিমারা বোধ হয় খুব রেগে গেলেন, তাই এতক্ষণ কিছু বলেননি, এবার হঠাৎ আমার দিকে ফিরে খুব ধমকধামক করতে লাগলেন, এইটুকু মেয়ে, তবু বড়োদের কথা শোনা; হেন-তেন কত কী!
আর একটু রাত হলে জগদীশদা এসে নীচু গলায় বললে, ও মামিমা, তোমরা কি একটা খুব ভালো চাকর রাখতে চাও? দশ টাকা মাইনে, দু-বেলা পেট ভরে ভাত, দু-বেলা চা-জলখাবার, বছরে চারখানি কাপড়, ব্যস্।
জেঠিমা বললেন, ঠাকুর ছুটি চাইছে, লোক অবিশ্যি আমাদের সত্যি দরকার, কিন্তু অত চায় কেন?
জগদীশদা কপালে চোখ তুলে বললে, অত মানে কী? তার বদলে কী পাচ্ছ জান? সাক্ষাৎ একটি দ্রৌপদী! ওর রান্না যদি একবার খাও তো সারাজীবন হা-হুঁতাশ করে মরবে! চপ-কাটলেট রাঁধে তো দাঁতের মধ্যে কুরকুর করে ওঠে, আবার মুখে যেতেই মিলিয়ে যায়।
মাংস রাঁধে যেন ক্ষীর। আর পায়েস-পিঠে বাঙালি হয়ে জন্মানোর দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। রাখ তো বলো, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ডেকে আনি। খুব ভালো লোক, খুব চেনা আমার।
জেঠিমা বললেন, তা রাখলে মন্দ হয় না, ঠাকুর তো পাস পার্মিট করিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে রয়েছে। তার দু-মাস মানেই সাত মাস। তাই তাকে আন তো দেখি।
জগদীশদা এক দৌড়ে গিয়ে একমুখ দাড়ি গোঁফওয়ালা একটা লোককে ধরে নিয়ে এল।