দিব্যি বড়ো একটা আরামকেদারায় বসে, মোড়ার ওপর পা দুটি উঠিয়ে, নাকের ওপর চশমা লাগিয়ে, নাতনির জন্যে ক্রুশ দিয়ে লেস বুনতে লেগে গেলেন। ওদিকে কী হচ্ছে সে দেখবার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই, মুখে গোটা দুই পান পুরে একমনে বুনছেন।
মিনিট দশেকও যায়নি, হঠাৎ মনে হল কে তাকে একদৃষ্টে দেখছে। চমকে যেইনা মুখ তুলেছেন, অমনি টুপ করে ঘরের আলো নিভে গেছে।
চ্যাঁচাবার জন্যে হাঁ করেছেন, অমনি কে একটা নতুন গামছা মুখের মধ্যে ঠুসে দিয়ে, মাথার চারদিকে দু-বার ঘুরিয়ে চেয়ারের পেছন দিকের সঙ্গে জড়িয়ে বেঁধে দিয়েছে।
বড়ো মাসিমার হাত-পা তো পেটের ভেতর সেঁদিয়েছে!
পরে সবাই মিলে জেরা করাতে বেরুল যে কেউ তাকে মারেনি, ছোঁয়নি। শুধু ভালো করে মুখ বেঁধে দিয়েছিল। পরে কে যেন গিঁটের ওপর একটু হাত দিতেই খসে পড়েছিল।
কিন্তু সে-সময় বড়ো মাসিমার মনে হয়েছিল দারুণ ষণ্ডা একটা লোক হাতে নিশ্চয় ঘন লোম, আর ওসবের লোকের সঙ্গে যে দু-দিকে ধার-দেওয়া বেঁটে ছুরি নেই, তাই-বা কে বললে!
মনে হয়েছিল সে একাও নয়, সঙ্গে হালকা ওজনের কে একটা ঘরময় ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হয়তো একটি ছোটো ছেলে। ডাকাতদের দলে নাকি ও-রকম থাকে একটা, তার কোমরে দড়ি বেঁধে, ফোকর-ফাটল দিয়ে ভেতরে গলিয়ে দেওয়া হয়, আর তারাও নিঃশব্দে গেরস্তর যথাসর্বস্ব পাচার করে দেয়।
লোকগুলো নাকি বড়োজোর ঘরে মিনিট পাঁচেক ছিল। তারি মধ্যে সব চেঁছেপুঁছে নিয়ে গেছে। একটু বাদেই মেয়েরা ড্রেস চেঞ্জ করতে এসে, বড়ো মাসিমাকে ওই অবস্থায় দেখে যত-না অবাক হল, কাপড়-চোপড় সব লোপাট হয়ে গেছে দেখে হাউমাউ করল তার চেয়ে বেশি!
আমার বন্ধু অনু সেজেছিল লক্ষ্মী। ভাগ্যিস প্রথম থেকেই তার মার বিয়ের বেনারসিখানা পরা ছিল, নইলে সেটিও যেত! আর আমরা ছিলুম কিনিবিনির দলে, অত পোশাক-আশাকের দরকারই ছিল না আমাদের; ক্ষিরি যখন ঝি তখন আমার ছেঁড়া চাদর জড়িয়ে; আর ক্ষিরি যখন রানি তখন চাদর খুলে লাল-নীল ঢাকাই কাপড়ে। কাজেই গেলুম বেঁচে।
কিন্তু মঞ্জি হয়েছিল ক্ষিরি। ওর বাবা সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিয়েছিলেন, কাজেই আর কাকেও ক্ষিরি সাজানো যায় না। ওকে বারে বারে ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে। পাছে কোনো গোলমাল হয়, তাই বোর্ডিং থেকে আলনা আনিয়ে, তাতে থাকে থাকে শাড়ি-জামা সাজিয়ে রেখেছিল। সে সব হাওয়া!
মঞ্জির বাড়িসুদ্ধ সকলের সে কী চাঁচামেচি!
পুলিশ এল। এসেই জগদীশদার পিসিমার কথায় গুটেকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। কিন্তু সেও যে কোথায় গিয়ে গা ঢাকা দিল, তার আর কোনো পাত্তাই পাওয়া গেল না।
সবচেয়ে দুঃখিত হলেন লাবণ্যদি। গেটের কাছে কাঁদো কাঁদো মুখে বলতে লাগলেন, সবই আমার বুদ্ধির দোষে হয়েছে। সাজঘরের কাছে আরও লোক রাখা উচিত ছিল।
সবাই মিলে তখন তাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিতে লাগল।
হল না অভিনয়, যে যার বাড়ি ফিরে গেল কিন্তু সে রাত্রে ঘুমোয় কার সাধ্যি। পুলিশের খাতায় সবার নাম উঠেছে, বাড়ি বাড়ি সার্চ হচ্ছে।
জগদীশদাদের বাড়ি যখন গেছে, পিসিমা তাদের বেশ দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছেন।
আসল চোরকে ধরবার নামটি নেই। আবার প্যান্ট পরে বেল্টএঁটে ভদ্দর লোকের বাড়ি গিয়ে গভীর রাতে হানা দাও ইত্যাদি!
জগদীশদা তো ভয়েই মরে, এই বুঝি পিসিমাকে ধরে নিয়ে যায়।
পরদিন বিকেলে বোর্ডিঙের বড়ো মাসিমা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। জেঠিমার সঙ্গে ভারি ভাব। এসেই বললেন, দিদি, মনে যে কী দারুণ অশান্তি নিয়ে বেড়াচ্ছি সে আর কী বলব! সবকথা তো কাউকে বলিনি। ওই লোকগুলো খুব মন্দ নয়। যাবার সময় আমার কোলে এই দশটা টাকা ফেলে দিয়ে গেছল। গরিব মানুষ, হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করছে না। নাতনিটার তো বিয়ে দিতে হবে।
এই বলে জেঠিমার সামনে দশটা টাকা রাখলেন। সাধারণ টাকা নয়, যদিও সেকালের টাকা এমন কিছু খারাপ ছিল না, রুপো দিয়ে তৈরি, বেশ ভারীই ছিল। এগুলো তার চাইতে অনেক বড়ো, খুব পুরোনো, কালো হয়ে যাওয়া, ওপরে মহারানি ভিক্টোরিয়ার ছাপ মারা।
জেঠিমা অবাক হয়ে বললেন, আরে, এ তো যে-সে টাকা নয়। এ নিশ্চয় কারো জমানো টাকা হবে। এসব তো আজকাল চলবে না। ওরা এ কোথায় পেল?
চলবে না শুনে বড়ো মাসিমার মুখ ফ্যাকাশে।
মা বললেন, বাজারে না চললেও, ব্যাঙ্কেট্যাঙ্কে দিলে হয়তো এক টাকার জায়গায় পাঁচ টাকাই পাওয়া যাবে। এসব জিনিসের অনেক দাম। কোথায় পেল আমিও তাই ভাবি।
জগদীশদার পিসিমাও এসেছিলেন সেদিন, ঝুড়ি ঝুড়ি নালিশ নিয়ে। এতক্ষণ হাঁ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ বলাকওয়া নেই, লাফিয়ে উঠে ঝড়ের মতো বেরিয়ে, সোজা বাড়ির পথ ধরলেন।
পিসিমা চলে যেতেই, গোল গোল চোখ করে বড়ো মাসিমা জেঠিমাকে বললেন, তা দিদি ওনাকে আপনারা নিজের লোক মনে করতে পারেন। কিন্তু উনিও কিছু কম যান না। বলুন তো, অত সোনাদানা পেলেন কোথায় যে আজ কৌটো হারায়, কাল কানের ফুল হারায়? বাবার দেওয়া না হাতি! সে বুড়োকে আমার বেশ মনে আছে। আট হাত কাপড় পরে সারা শীতকাল কাটিয়ে দিত, নিরামিষ খেত, গয়লাকে পয়সা দিত না। ওর ঘরে অত সোনাদানা কেমন করে আসবে গা?
মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না, উনি বোধ হয় খুব কিপটে ছিলেন। গয়নাগাটি তুলে রাখতেন, খরচপত্র করতেন না।