–সাব বখশিশ, সাব বখশিশ!
একসঙ্গে অনেকগুলো দেহাতী গলা চিৎকার করে উঠলো।
মেজরের কাছে ফর্ম ও. কে. করাতে গিয়ে আমি চমকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম, শুধু বাচ্চা ছেলে দুটো নয়, কয়েকটা জোয়ান পুরুষও হাত বাড়িয়েছে। খাটো শাড়ির একটা তুখোড় শরীরের মেয়েও
একদিন সবজি নিতে গিয়েছিলাম, ঐ মেয়েটা হেসে হেসে জিগ্যেস করেছিলো, টিরেন কবে আসবে।
এক-একদিন অকারণেই ওরা দল বেঁধে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো, অপেক্ষা করে করে চলে যেতো।
কাঁধে-স্ট্রাইপ তিন-চারটে আমেরিকান ততক্ষণে হিপ পকেট থেকে মুঠো মুঠো আনি দু-আনি বের করে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে। ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করেনি, ওরা হুমড়ি খেয়ে পড়লো পয়সাগুলোর ওপর। হুড়োহুড়িতে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে হাত-পা ছড়ে গেল কারও, কারও বা নেংটির কাপড় ফেঁসে গেল।
ট্রেন চলে যাওয়ার পর ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম ওদের। মনে হলো মাহাতো-গাঁয়ের আধখানাই এসে জড় হয়েছে। সবারই মুখে ফুর্তির হাসি, সবাই কিছু-না-কিছু পেয়েছে। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেই টাঙি-জুতোর মাহাতো বুড়োকে দেখতে পেলাম না। মাহাতো বুড়ো আসেনি। সেদিন ওর আপত্তি, ওর ধমক শুনেও পয়সাগুলো ফেলে দেয়নি ছেলে দুটো। তাই বোধ হয় রেগে গিয়ে আর আসেনি।
আমার ভাবতে ভালো লাগলো বুড়োটা ক্ষেতে দাঁড়িয়ে একা-একা মাটি কোপাচ্ছে।
আমাদের দিন, কুক ভগোতীলালকে নিয়ে আমাদের পাঁচজনের দিন আন্ডা হল্টের তাঁবুর মধ্যে কোনোরকমে কেটে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে এক-একদিন সৈনিক-বোঝাই ট্রেন আসছিলো, থামছিলো, চলে যাচ্ছিলো। মাহাতো-গাঁয়ের লোক ভিড় করে এসে কাঁটাতারের ধারে সারি দিয়ে দাঁড়াতো, হাত বাড়িয়ে সবাই ‘সাব বখশিশ, সাব বখশিশ’ চেঁচাতো।
হঠাৎ এক-একদিন মাহাতো বুড়োকে দেখতে পেতাম কোনো দিন ক্ষেতের কাজ ফেলে দু হাতের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হনহন করে এগিয়ে আসতো, রেগে গিয়ে ধমক দিতে সকলকে ওর কথা শুনছে না বলে কখনো বা অসহায় প্রতিবাদের চোখে গাঁয়ের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো।
কিন্তু ওর দিকে কেউ ফিরেও তাকাতো না। সৈনিকরা হিপ পকেটে হাত দিয়ে হা-হা করে হাসতে হাসতে মুঠো-ভরতি পয়সা ছুঁড়ে দিতো। মাহাতো-গাঁয়ের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়তো সেই পয়সাগুলোর ওপর, নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ঝগড়া বাধাতো। তা দেখে সৈনিকরা হা-হা করে হাসতো।
শেষে পর পর কয়েক দিন লক্ষ করলাম টাঙি-জুতো পরা মাহাতো বুড়ো আর আসে না মাহাতো বুড়ো ওদের দেখে রেগে যেতে বলে, মাহাতো বুড়ো আর আসতো না বলে আমার এক ধরনের গর্ব হতো। কারণ, এক-একসময় ঐ লোকগুলোর ব্যবহারে আমরা—আমি আর ভগোতীলাল খুব বিরক্তি বোধ করতাম ভিতরে ভিতরে লজ্জা পেতাম ওদের কালেকুলো দীন দরিদ্র বেশ দেখে সৈনিকের দল নিশ্চয় ওদের ভিখিরী ভাবতে ভাবতো বলেই আমার খুব খারাপ লাগতো।
সেদিন কাঁটাতারের ওপার থেকে ওরা বখশিশ বখশিশ বলে চিৎকার করছে, কাঁধে আই ই খাকী বুশ-শার্টের গার্ড জানকীনাথের সঙ্গে আমি গল্প করছি, আমাদের পাশ দিয়ে একজন অফিসার মচমচ করে যেতে যেতে চিৎকার শুনে থুতু ফেলার মতো গলায় বলে উঠলো, ব্লাডি বেগার্সা
আমি আর জানকীনাথ পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম আমাদের মুখ অপমানে কালো হয়ে গেল মাথা তুলে তাকাতে পারলাম না। শুধু অক্ষম রাগে ভিতরে ভিতরে জ্বলে উঠলাম
ব্লাডি বেগার্স, ব্লাডি বেগার্স।
সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো মাহাতোদের ওপর। ট্রেন চলে যেতেই আমি ভগোতীলালকে সঙ্গে নিয়ে ওদের তাড়া করে গেলাম। ওরা কুড়োনো পয়সা ট্যাঁকে গুঁজে হাসতে হাসতে পালালো।
তবু ওদের জন্যে সমস্ত লজ্জা আমি একটা অহঙ্কারের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম। পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে সেই অহঙ্কারটা আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো মাহাতো বুড়োর চেহারা নিয়ে।
কিন্তু সেদিন আমার বুকের মধ্যের সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে গেল।
ভুরকুণ্ডায় ঠিকাদারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই খবর পেয়েছিলাম।
সার্ভার দুজন কুলি তখন টেবিল বানানো ড্রাম দুটোকে পায়ে ঠেলে ঠেলে আন্ডা হল্টের কাঁটাতারের ওপারে সরিয়ে দিচ্ছিলো। তাঁবুর দড়ি খুলছিলো আরেকজন। ভগোতীলাল ড্রামটার গায়ে একটা জোর লাথি মেরে বললে, খেল খতম, খেল খতম।
হঠাৎ হইহল্লা শুনে চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি মাহাতো-গাঁয়ের লোক ছুটতে ছুটতে আসছে।
আমরা অবাক হয়ে তাকালাম তাদের দিকে। ভগোতীলাল কি জানি কেন হেসে উঠলো।
ততক্ষণে কাঁটাতারের ওপারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে গেছে ওরা।
সঙ্গে সঙ্গে একটা হুইসল শুনতে পেলাম, ট্রেনের শব্দ কানে এলো।
ফিরে তাকিয়ে দেখি ট্রেনটা বাঁক দিয়ে আন্ডা হল্টের দিকেই আসছে, জানালায় জানালায় খাকী পোশাক।
আমরা বিব্রত বোধ করলাম, আমরা অবাক হলাম। তা হলে কি খবর পাঠাতেই ভুলে গেছে ভুরকুণ্ডার আপিস? না যে খবর শুনে এসেছি সেটাই ভুল?
ট্রেনটা যত এগিয়ে আসছে ততই একটা অদ্ভুত গমগম আওয়াজ আসছে। আওয়াজ নয়, গান। একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল সমস্ত ট্রেন, ট্রেন-ভরতি সৈনিকের দল পরস্পরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছে।
বিভ্রান্তের মতো আমি একবার ট্রেনটার দিকে তাকালাম, একবার কাঁটাতারের ভিড়ের দিকে। আর সেই মুহূর্তে চোখ পড়লো সেই মাহাতো বুড়োর দিকে। সমস্ত ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে মাহাতো বুড়োও হাত বাড়িয়ে চিৎকার করছে, সাব বখশিশ, সাব বখশিশ