ওরা অবাক হয়ে সৈনিকটার দিকে তাকালো, কাঁটাতারের ভিতরে মোরামের ওপর পড়ে থাকা চকচকে আধুলিটার দিকে তাকালো, নিজেরা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো, তারপর অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই রইলো।
ট্রেনটা চলে যাবার পর ওরা নিঃশব্দে ফিরে চলে যাচ্ছিলো দেখে আমি বললাম, সাহেব বখশিশ দিয়েছে, বখশিশ তুলে নো
সবাই সকলের মুখের দিকে তাকালো, কেউ এগিয়ে এলো না।
আমি আধুলিটা তুলে মাহাতো বুড়োর হাতে দিলাম। সে বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর সবাই নিঃশব্দে চলে গেল। কারও মুখে কোনো কথা নেই।
আমার এই ঠিকাদারের তাঁবেদারি একটুও ভালো লাগতো না। জনমনুষ্য নেই, একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দাঁড়ায় না, তাঁবুতে ভগোতীলাল আর তিনটে কুলি। নির্জন, নির্জন মাটি রুক্ষ, দুপুরের আকাশ রুক্ষ, রুক্ষ আমার মন।
মাহাতো-গাঁয়ের লোকরাও কাছে ঘেঁষতো না। মাঝে মাঝে গিয়ে সবজি কিংবা চুনো মাছ কিনে আনতাম। ওরা বেচতে আসতো না, কিন্তু ভুরকুণ্ডার হাটে যেতো তিন ক্রোশ পথ হেঁটে।
দিন কয়েক কোনো ট্রেনের খবর ছিলো না। চুপচাপ, চুপচাপ।
হঠাৎ সেই কোমরের ঘুনসিতে লোহা-বাঁধা ছেলেটা একদিন এসে জিগ্যেস করলো, টিরেন আসবে না বাবু?
হেসে ফেলে বললাম, আসবে, আসবে।
ছেলেটার আর দোষ কি, বেঁটে বেঁটে পাহাড়, রুক্ষ জমি, একটা দেহাতী ভিড়ের বাস দেখতে হলেও দু ক্রোশ হেঁটে যেতে হয় খয়েরগাছের ঝোপের মধ্যে দিয়ে। সকালে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন একটুও স্পীড না কমিয়ে হুস করে বেরিয়ে যেতো, বিকেলের ডাউন ট্রেনটাও থামতো না, তবু কয়েক মুহূর্ত জানালায় জানালায় ঝাপসা মুখ দেখার জন্যে আমরা তাঁবুর ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতাম মানুষ না দেখে আমরা হাঁপিয়ে উঠতাম।
তাই আমেরিকান সৈনিকদের স্পেশাল ট্রেন আসছে শুনলে যেমন বিব্রত বোধ করতাম তেমনি আবার স্বস্তিও ছিলো।
দিন কয়েক পরেই প্রথমে এলো খবর, তার পরদিন মিলিটারী স্পেশাল ঝুপঝাপ করে জি. আইরা নামলো, সারি দিয়ে সব ডিম রুটি মগ-ভরতি কফি নিলো।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে মাহাতো-গাঁয়ের ভিড় ভেঙে পড়েছে। বিশ হতে পারে, তিরিশ হতে পারে, হাঁটুসমান বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কত কে জানে। খাটো শাড়ির মেয়েগুলোও বোকা-বোকা চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলো। ওদের দেখে আমার কেমন ভয়-ভয় করলো। ভগোতীলাল কিংবা সার্ভার কুলি তিনটে মাহাতো-গাঁয়ের দিকে যেতে চাইলে আমার বড় ভয়-ভয় করতো।
প্ল্যাটফর্ম তো ছিলো না, শুধু উঠতে নামতে সুবিধের জন্যে লাইনের ধারটুকু মোরাম ফেলে উঁচু করা হয়েছিলো। আমেরিকান সৈনিকরা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে পায়চারি করছিলো। দু একজন স্থির দৃষ্টিতে মাহাতো-গাঁয়ের কালো কালো মানুষগুলোকে দেখছিলো।
হঠাৎ একজন ভগোতীলালের দিকে এগিয়ে গিয়ে হিপ পকেট থেকে ব্যাগ বের করলো, ব্যাগ থেকে একখানা দু টাকার নোট, তারপর জিগ্যেস করলে, কয়েনস আছে? নোটভাঙানো খুচরো সৈনিকরা কেউ রাখতেই চাইতো না, পয়সা ফেরত না নিয়ে দোকানী কিংবা ফেরিওয়ালা কিংবা ট্যাকসি ড্রাইভারকে বলতো, ঠিক আছে, ঠিক আছে। রাঁচিতে গিয়ে কয়েকবার দেখেছি।
এক-আনি, দু-আনি আর সিকি মিলিয়ে ভগোতীলাল ভাঙিয়ে দিচ্ছিলো, হঠাৎ দেখি কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে ভিড়ের ভিতর থেকে কোমরের ঘুনসিতে লোহার টুকরো বাঁধা সেই ছেলেটা হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে কি চাইছে।
সঙ্গে সঙ্গে ভগোতীলালের কাছ থেকে সেই খুচরো আনি দু-আনিগুলো মুঠোর মধ্যে নিয়ে সেই আমেরিকান সৈনিক মাহাতোদের দিকে ছুঁড়ে দিলো।
আমার তখন সাপ্লাই ফর্ম ও.কে. করানো হয়ে গেছে, গার্ড হুইসল দিয়েছে।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে, অমনি মাহাতোদের দিকে ফিরে তাকালাম।
ওরা তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো, তাকিয়ে ছিলো। তারপর হঠাৎ, লাল মোরামের ওপর, ছড়ানো পয়সাগুলোর ওপর কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো কোমরের ঘুনসিতে লোহা বাঁধা ছেলেটা আর গলায় লাল সুতলিতে দস্তার তাবিজ বাঁধা ছেলেটা
সেই মুহূর্তে টাঙি-জুতো পরা মাহাতো বুড়ো ধমক দিয়ে বলে উঠলো, খবরদার! এমন জোরে চিৎকার করলো যে আমি নিজেও চমকে উঠেছিলাম।
কিন্তু বাচ্চা দুটো ওর কথা শুনলো না। তারা দুজনে তখন যে যত পেরেছে আনি দু-আনি কুড়িয়ে নিয়েছে। মুখ খোসা-ছাড়ানো কচি ভুট্টার মতো হাসছে। মেয়েপুরুষের সমস্ত ভিড় হাসছে।
টাঙি-জুতো পরা মাহাতো বুড়ো রেগে গিয়ে তাদের ভাষায় অনর্গল কি সব বলে গেল। মেয়েপুরুষের ভিড় হাসলো।
মাহাতো বুড়ো রাগে গজগজ করতে করতে গাঁয়ের দিকে চলে গেল একাই। মাহাতো-গাঁয়ের লোকগুলোও চলে গেল কলকল কথা বলতে বলতে, খলখল হাসতে হাসতে
ওরা চলে যেতেই আন্ডা হল্ট আবার নির্জন নিস্তব্ধ শূন্যতা আমার এক-একসময় ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেতো। দূরে দূরে পাহাড়, মহুয়ার বন, খয়েরের ঝোপ পার হয়ে একটা ছোট্ট জল চোঁয়ানো ঝরনা, মাহাতো-গাঁয়ের সবুজ ক্ষেত। চোখ জুড়িয়ে যায়, চোখ জুড়িয়ে যায় তার মধ্যে। কালো কালো নেংটি-পরা মানুষ।
এদিকে মাঝে মাঝেই আমেরিকান সোলজারদের ট্রেন আসে, থামে, ডিম রুটি মগ-ভরতি কফি খেয়ে চলে যায়। মাহাতো-গাঁয়ের লোক ভিড় করে আসে, কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে সারি দিয়ে দাঁড়ায়।