ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলো ট্রেনটা। কিংবা রাঙা-মুখ আমেরিকান সৈনিকদের দেখছিলো।
একজন সৈনিক তাকে দেখতে পেয়ে হঠাৎ ‘হে-ই’ বলে চিৎকার করলো, আর সঙ্গে সঙ্গে নেংটি-পরা ছেলেটা পাঁইপাঁই করে ছুটে পালালো মাহাতোদের গাঁয়ের দিকে কয়েকটা আমেরিকান সৈনিক তখন হা-হা করে হাসছে।
ভেবেছিলাম ছেলেটা আর কোনো দিন আসবে না।
মাহাততারা কেউ আসতো না, কেউ না। ক্ষেতিতে কাজ করতে করতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওরা শুধু অবাক-অবাক চোখ মেলে দূর থেকে দেখতো।
কিন্তু তারপর আবার যেদিন ট্রেন এলো, ট্রেন থামলো, সেদিন আবার দেখি কোমরের ঘুনসিতে লোহা বাঁধা ছেলেটা কাঁটাতারের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে আরেকটা ছেলে, তার চেয়ে আরেকটু বেশী বয়েস। গলায় লাল সুতোয় ঝুলোনো দস্তার তাবিজ, ভুরকুণ্ডার হাটে একদিন গিয়েছিলাম, রাশি রাশি বিক্রি হয় মাটিতে ঢেলে, রাশি রাশি সিঁদুর, তাবিজ, তামার পিতলের দস্তার, বাঁশে ঝোলানো থাকে রঙিন সুতলি, পুঁতির মালা একটা ফেরিওলাকে দেখেছি কখনো কখনো এক হাঁটু ধুলো নিয়ে, কাঁধে অগুন্তি পুঁতির ছড়, দূর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাহাতোদের গাঁয়ের দিকে যায়।
ছেলে দুটো অবাক-অবাক চোখ মেলে কাঁটাতারের ওপারে দাঁড়িয়ে আমেরিকান সৈনিকদের দেখছিলো। প্রথম দিনের বাচ্চাটার চোখে একটু ভয়, হাঁটু তৈরী, কেউ চোখে একটু ধমক মাখালেই সে চট করে হরিণ হয়ে যাবে।
আমি হাতে ফর্ম নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলাম, সুযোগ পেলে হেসে হেসে মেজরকে তোয়াজ করছিলাম। একজন সৈনিক তার কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মগে চুমুক দিতে দিতে ছেলে দুটোকে দেখে পাশের জি আই-কে বললে, অফুল!
আমার এত দিনে মনে হয়নি। ওরা তো দিব্যি ক্ষেতে-খামারে কাজ করে, গুলতি নয়তো তীরধনুক নিয়ে খাটাশ মারে, নাটুয়া গান শোনে, হাঁড়িয়া খায়, ধনুকের ছিলার মতো কখনো টান টান হয়ে রুখে দাঁড়ায়। নেংটি-পরা সরু শরীর, কালো, রুক্ষ। কিন্তু ব্যাটা জি আই-এর ‘অফুল’ কথাটা যেন আমাকে খোঁচা দিলো। ছেলে দুটোর ওপর আমার খুব রাগ হলো।
সৈনিকদের কে একজন গলা ছেড়ে এক কলি গান গাইলো, দু-একজন হা-হা করে হাসছিলো, একজন চটপট কফির মগে চুমুক দিয়ে সার্ভার কুলিটাকে চোখ মেরে আবার ভরতি করে দিতে বললে। গার্ড এগিয়ে দেখতে এলো আর কত দেরি পাঞ্জাবী গার্ড কিন্তু দিব্যি চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে কথা বললে মেজরের সঙ্গে।
তারপর হুইসল বাজলো, ফ্ল্যাগ নড়লো, সবাই চটপট উঠে পড়লো ট্রেনে, হাতে চওড়া লাল ফিতে বাঁধা মিলিটারী পুলিসরাও।
ট্রেন চলে গেলে আবার সেই শূন্যতা, ধু-ধু বালির মধ্যে ফণিমনসার গাছের মতো শুধু সেই কাঁটাতারের বেড়া।
দিন কয়েক পরেই আবার একটা ট্রেন এলো। এবার পি ও ডবলু গাড়ি, ইটালীয়ান যুদ্ধবন্দীরা রামগড় থেকে আবার কোথাও চালান হচ্ছে। কোথায় আমরা জানতাম না, জানতে চাইতাম না।
ওদের পরনে স্ট্রাইপ-দেওয়া অন্য পোশাক, মুখে হাসি নেই, রাইফেল উঁচিয়ে সারাক্ষণ ওদেরই ট্রেনটা চারদিক থেকে গার্ড দেওয়া হতো। আমাদেরও একটু ভয় ভয় করতো। ভুরকুণ্ডায় গল্প শুনে এসেছিলাম, একজন নাকি ধুতিপাঞ্জাবি পরে পালাবার চেষ্টা করেছিলো, পারেনি। বাঙালী বলেই আমার আরো ভয়-ভয় করতো।
ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর লক্ষ করলাম, কাঁটাতারের ওপারে শুধু সেই বাচ্চা ছেলে দুটো নয়, খাটো কাপড়ের একটা বছর পনেরোর মেয়ে, দুটো পুরুষ ক্ষেতের কাজ ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছিলো। ট্রেন চলে যাওয়ার পর ওরা নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করলো, হাসলো, কলকল করতে করতে ঝরনার জলের মতো মাহাতোদের গাঁয়ের দিকে চলে গেল।
একজন, দুজন, পাঁচজন সেদিন দেখি জন দশেক মাহাতো-গাঁয়ের লোক ট্রেন আসতে দেখেই মাঠ থেকে দৌড়তে শুধু করেছে। ট্রেনের জানালায় জানালায় খাকী রঙ দেখেই বোধ হয় ওরা বুঝতে পারতো। দিনে দুখানা প্যাসেঞ্জার মেল ট্রেনের মতো হুস করে বেরিয়ে যেতো, দু একখানা গুডস ট্রেন ঠুংঠুং করতে করতো তখন তো কই থামবে ভেবে মাহাতো-গাঁয়ের লোক আসতো না ভিড় করে!
একদিন গিয়ে বলেছিলাম মাহাতো বুড়োকে, লোক পাঠিয়ে আমাদের আন্ডা হল্টের তাঁবুতে বেচে আসতে সবজি আর চিংড়ি, সরপুঁটি, মৌরলা।
বুড়ো হেসে বলেছিলো–ক্ষেতির কাজ ছেড়ে যাবো নাই।
তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম। কালো কালো নেংটি-পরা লোকগুলোকে, খাটো শাড়ির মেয়েগুলোকে। শুধু খালি-গা মাহাতো বুড়োর পায়ে একটা টাঙি-জুতো, গেঁয়ো মৃধার কাছে বানানো টাঙি-জুতো, এসে সারি দিয়ে ওরা কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে দাঁড়ালো।
ট্রেন ততক্ষণে এসে গেছে। ঝুপঝাপ নেমে পড়ে আমেরিকান সৈনিকের দল সারি দিয়ে চলেছে মগ আর থালি হাতে
দু শো আঠারো ব্রেকফাস্ট তখন রেডি বি এফ থ্রি থার্টি টু-তো বি এফ থ্রি থার্টি টু মানে আন্ডা হল্ট।
তখন একটু শীত-শীত পড়তে শুরু করেছে। দূরের পাহাড়ে কুয়াশার মাফলার জড়ানো গাছগাছালি শিশির-ধোয়া সবুজ।
একজন সৈনিক ইয়াঙ্কি গলায় মুগ্ধতা প্রকাশ করলো।
আরেকজন কামরার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁটাতারের ওপারের রিক্ততার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ কফির মগটা ট্রেনের পা-দানিতে রেখে সে হিপ পকেটে হাত দিলো। ব্যাগ থেকে একটা চকচকে আধুলি বের করে ছুঁড়ে দিলো মাহাতোদের দিকে।