ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি পড়াতেন প্রফেসর আলি নওয়াব। তখন অবশ্যি তিনি রিডার (সহযোগী অধ্যাপক)। ক্লাসে ঢুকেই বললেন, বইগুলিতে যা পড়বে সবই বিশ্বাস করবে না। অনেক মিথ্যা কথা লেখা আছে।
আমরা স্তম্ভিত। বই-এ মিথ্যা কথা মানে?
স্যার বললেন, বইগুলিতে অনেক ভুল তথ্য থাকে। আমি সেগুলি তোমাদের দেখিয়ে দেব। তোমরা নিজেরাও ধরতে চেষ্টা করবে। প্রচুর গোঁজামিল আছে। ভুল থিওরী আছে।
আমরা বিস্মিত, বই-এ লেখা থিওরী ভুল! কি আশ্চর্য কথা। স্যার শুধু মুখেই বললেন না–ভুল দেখিয়ে আমাদের চমকে দিলেন।
চার ঘণ্টার ল্যাব। এক মুহূর্তের বিশ্রাম নেই। কাজ শেষ করতে হবে। অসংখ্য কাজ। গোদের উপর বিষফোড়ার মত ল্যাব ক্লাসে দুদিন পরপর ভাইভা। ভাইভা ভাল না হলে স্যাররা স্কলারশীপের বিলে সই করেন না। গার্ডিয়ানের কাছে চিঠি চলে যায়–পড়াশোনা সন্তোষজনক নয়।
আজ যখন কেউ বলে, আপনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেমন কেটেছে? আমি নস্টালজিক কারণে বলি, খুব চমৎকার! অসাধারণ!
আসলে কিন্তু খুব চমৎকার বা অসাধারণ জীবন তা ছিল না। কেন ছিল না একটু বলি চব্বিশ বছর আগে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক মোটেই ভাল ছিল না। শিক্ষকরা ছিলেন অন্য গ্রহের মানুষ। তাঁরা অনেকখানি দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। ক্লাস রুমের বাইরে ছাত্রদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল না বললেই হয়। ছাত্রদের কোন সমস্যায় তাঁদের কোন সহানুভূতি ছিল বলেও মনে হয় না।
না-হওয়াটাই স্বাভাবিক। যোগাযোগ থাকলে তবেই তো সহানুভূতি তৈরি হবে। যোগাযোগই তো নেই।
একটা ঘটনা বলি–রসায়ন বিভাগের বারান্দায় একটি ছেলে এবং মেয়ে মাথা নিচু করে গল্প করছিল। গল্প করার ভঙ্গিটি হয়ত আন্তরিক ছিল। এবং তারা গল্পও করছিল দীর্ঘ সময়। চেয়ারম্যনের ঘরে দুজনেরই ডাক পড়ল। চেয়ারম্যান সাহেব তাদের কি বললেন জানি না। মেয়েটি বের হয়ে এল কাঁদতে কাঁদতে। ছেলেটিকে ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে যেতে হল।
সন্ত্রাস আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং অন্যতম সমস্যা। চব্বিশ বছর আগেও কিন্তু সন্ত্রাস একটি বড় সমস্যাই ছিল। এন এস এফ নামে তখন সরকার সমর্থিত একটি ছাত্র দল ছিল। তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছিল। তারা ঘুরতো হকি স্টিক নিয়ে, ছুরি নিয়ে। কারো কারো হাতে থাকতো রিকশার চেইন। রিকশার চেইন না-কি অস্ত্র হিসেবে ভয়াবহ। দুএকজন ভাগ্যবানের কাছে ছিল পিস্তল।
অন্য হলের কথা জানি না। আমাদের মহসিন হলে মাস্তান ছেলেদের জন্যে হলের বাবুর্চি আলাদা করে রান্না করত। তাদের খাবার পৌঁছে যেত তাদের ঘরে। এর জন্যে তাদের আলাদা কোন টাকা-পয়সা দিতে হত না। হলের শিক্ষকরা এইসব ব্যাপার অবশ্যই জানতেন। জেনেও না জানার ভান করতেন। আমি একটি ভয়াবহ ঘটনার উল্লেখ করে আমার কথার সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করব।
সবে সন্ধ্যা হয়েছে, পলিটিক্যাল সায়েন্সের আমার পরিচিত এক ছাত্র মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ছুটে এসে বলল, ছতলায় এক কাণ্ড হচ্ছে, দেখে। আস। গেলাম ছ তলায়। একেবারে সিঁড়ির গোড়ার ঘরটা বন্ধ। ভেতর থেকে একটি মেয়ের চাপা কান্নার শব্দ আসছে। বাইরে তিন/চারজন কৌতূহলী ছেলে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, কি হয়েছে?
তারা চাপা গলায় বলল, একটা মেয়েকে আটকে রেখেছে।
তার মানে কি?
তার মানে যা বলল তাতে আমার মাথা খারাপ হবার অবস্থা। ছ থেকে সাতজন মাস্তান ঐ ঘরে আছে। নারকীয় কাণ্ড হচ্ছে বিকেল থেকে। মেয়েটা এক সময় চিৎকার করছিল–এখন তাও করছে না। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, স্যারদের বলা হয়েছে?
বলা হয়েছে। বলে লাভ নেই–স্যাররাও জানেন কারা এসব করছে।
আমি ছুটে গেলাম আমাদের ব্লকে যে অ্যাসিস্টেন্ট হাউস টিউটর থাকতেন তাঁর কাছে। তিনি বললেন, তুমি তোমার নিজের কাজে যাও, আমরা দেখছি কি করা যায়।
তাঁরা কিছুই দেখলেন না। এই ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে। আজকাল কিছু কিছু শিক্ষক যখন বলেন তাঁদের সময়টা ছিল স্বর্ণযুগ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছিলেন কঠিন। তখন অনেক কষ্টে আমি হাসি চাপি।
আমাদের সময়ই শহীদুল্লাহ হলের (ঢাকা হল) একজন হাউস টিউটরকে অপমান করবার জন্যে এক প্রসটিটিউটকে নিয়ে আসা হল। সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নাম ধরে ঐ শিক্ষককে ডাকতে লাগল।
সরকার সমর্থিত এন এস এফ এর প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল দেখার মত। কারো হলে সীট হচ্ছে না। এন এস এফ-এর বড় চাঁইকে ধরলেই সীট হয়ে যেত।
ত্রাস সৃষ্টিকারী কিছু চরিত্রের মধ্যে খোকা এবং পাঁচপাত্তুরের নাম মনে পড়ছে। এদের একজন পকেটে জীবন্ত সাপ নিয়ে বেড়াতো বলে শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়। এলাকায় সন্ত্রাসের সূচনা ওরাই করে। আমরা এখন সেই ট্র্যাডিশান বহন করে চলেছি–এর বেশি কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তখনো ছিলেন অসহায়, এখনো অসহায়। তাঁদের মেরুদণ্ড তখনো অশক্ত ছিল। এখনো অশক্ত আছে।
যাক এসব কথা। হল জীবনের কিছু স্মৃতির কথা বলি। হলে থাকা ছেলেদের মধ্যে একটা বড় অংশই ছিল দরিদ্র। অনেকেই প্রথম এসেছে ঢাকা শহরে। কিছুতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। টাকা-পয়সা যা দেশ থেকে আসছে তাতে প্রয়োজন মিটছে না। প্রাইভেট টিউশানি ব্যাপারটি তখনো চালু হয় নি। এদের বাড়তি রোজগার বলতে কিছু নেই। এই ছেলেগুলি কখনো সকালে নাশতা করে না। বিকেলেও কিছু খায় না। ক্ষিধেয় অস্থির হয়ে এরা অপেক্ষা করে কখন রাতের খাবার দেয়া হবে। সন্ধ্যা হতেই এরা ডাইনিং হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, কখন ডাইনিং হল খোলা হবে। এদের নিয়ে হলের অন্য ছাত্ররা নানান ধরনের রসিকতা করে। হাসাহাসি করে। হলের স্মৃতি মনে হলেই আমার এই ছেলেগুলির কথা মনে হয়। হল সম্পর্কে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এই ছেলেদের সব সুখস্মৃতি নিশ্চয়ই ক্ষুধার নিচে চাপা পড়ে গেছে। আমি হলে থাকাকালীন সময়েই এদের একজন ইলেকট্রিক হিটারের তার হাতে জড়িয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। না, কোন প্রেমঘটিত ব্যাপার না–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাবার মত অর্থ জোগাড় করতে পারছে না, আবার বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তেও পারছে না। সে এই কষ্ট থেকে মুক্তি চায়।