আমার দিকে না তাকালে আমি প্রশ্নের জবাবই বা কেন দেব? আমার একটু ভয় ভয় লাগছে কারণ এখন যা হচ্ছে তার নাম ভর্তির ইন্টারন্যু। ইন্টারভু ভাল হলে দরখাস্তে সই করে দেবেন। ভর্তি হয়ে যাব। ফট করে কেমিস্ট্রির কোন প্রশ্ন করে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ফর্মূলা একটাও মনে নেই। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা হয়ে যাবার পর আর বই খুলে দেখিনি।
আমার খানিকটা একা একাও লাগছে। সবার সঙ্গেই বাবা, খালু বা চাচা এসেছেন। কি পড়লে ভাল হয়, সাবসিডিয়ারী কি নেয়া যায় আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আমি একা। ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাবা চিঠি লিখে জানিয়েছেন–পড়াশোনার ব্যাপারটা তোমার। তুমি যা ভাল মনে কর তাই পড়বে। এখানে আমার বলার কিছু থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না।
খোন্দকার মোকাররম হোসেন স্যার পাশের মানুষটির সঙ্গে কথা বলা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমিস্ট্রি পড়তে কি তোমার ভাল লাগে? বলেই আগের মত পাশের মানুষটির সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেশ মজার ব্যাপার তো!
স্যারের কথা বলা শেষ হল। আমার দিকে একবার তাকিয়ে তৃতীয় কোন প্রশ্ন না করেই দরখাস্তে সই করে দিয়ে বললেন, মন দিয়ে পড়বে।
ভর্তির ব্যাপারটা খুব সহজে হয়ে গেল। আমি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। বিরাট এই বিশ্ববিদ্যালয়টা এখন আমার। আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার নিজের জায়গায়। আর কি সুন্দর জায়গা! কার্জন হল–ফুলের বাগানের ভেতর লাল ইটের দালান। প্রাচীন প্রাচীন ভাব। এত ছাত্র-ছাত্রী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারপরেও যেন সব শান্ত। প্রকাণ্ড দুটা শিরীষ গাছ কেমিস্ট্রি বিল্ডিংটাকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে।
কার্জন হলের পেছনেই কি বিশাল দুটা হল। ফজলুল হক হল এবং ঢাকা হল। এই হল দুটির সামনেও ফুলের বাগান। দুই হলের মাঝখানে সমুদ্রের মত বড় দীঘি। এই হল দুটির কামরাগুলি আমার পছন্দ হল না। কেমন যেন ছোট ছোট। আলো কম। সেই তুলনায় মহসিন হলকে খুব আকর্ষণীয় মনে হল। নতুন তৈরি হয়েছে। এখনো চালু হয় নি। এ বছরই চালু হবে। ঝকঝক করছে ছতলা আকাশছোঁয়া হল। দুটা লিফট আছে। লিফট আমি আগে কখনো দেখি নি। একবার লিফটে চড়েই মনে হল, এই হলে থাকতে না পারলে মানব জন্ম বৃথা।
মহসিন হলের প্রধান গৃহশিক্ষক তখন পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহযোগী। অধ্যাপক মোহাম্মদ এমরান। ইনি কারণে এবং অকারণে অতি দ্রুত রেগে যেতে পারেন। ইনার কাছে ইন্টারভু দিতে যাবার আগ মুহূর্তে একজন আমাকে বলল, স্যারের প্রশ্নের উত্তর খুব সাবধানে দিবে। একজন কি উল্টাপাল্টা কথা বলেছিল, স্যার তাকে চড় মেরেছেন।
কি সর্বনাশের কথা! ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসা ছাত্রের গালে কেউ চড় মারতে পারে? ভয়ে এতটুকু হয়ে স্যারের ঘরে ঢুকলাম। স্যার হুংকার দিয়ে উঠলেন, সায়েন্সের ছাত্র তুমি মহসিন হলে থাকবে কেন? সায়েন্সের ছাত্রদের জন্যে ফজলুল হক হল, ঢাকা হল।
আমি স্যার এই হলেই থাকব।
কেন?
এদের লিফট আছে স্যার।
স্যার হেসে ফেললেন। হেসে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে হল হাসা ঠিক হয় নি। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করবে না। স্ট্রেইট লাইন চেন? স্ট্রেইট লাইন বানিয়ে ছেড়ে দেব। বিছানা-বালিশ আছে?
আছে স্যার।।
বিছানা-বালিশ নিয়ে পাঁচ তলায় চলে যাও। তোমাকে একটা সিঙ্গেল সীটেড রুম দেয়া হল।
হলে ভর্তি, হলে সীট পাওয়ার ব্যাপারটা এত সহজ? বিশ্বাস হতে চায় না। আমি নিজের ঘরে ঢুকলাম। আগামী চার বছর এটাই আমার ঘর। রুম নাম্বার পাঁচশ চৌষট্টি। একটা কাগজে বড় বড় করে লিখলাম–
হুমায়ূন আহমেদ
রসায়ন প্রথম বর্ষ সম্মান
রোল ৩২
সেই কাগজ ঘরের দরজায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম।
নতুন হলে যাত্রা শুরু হল। প্রথম রাতেই ইমপ্রুভড ডায়েট। রোস্ট, রেজালা, দৈ। খাওয়ার শেষে হলের বাইরের দোকান থেকে জীবনের প্রথম সিগারেটটি কিনে গম্ভীর ভঙ্গিতে টানা শুরু করলাম। ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হয়েছি–অনেক বড় হয়ে গেছি। এখন গম্ভীর ভঙ্গিতে সিগারেট টানা যেতে পারে। মাথা ঘুরছে তাতে কি? বমি বমি আসছে? আসুক না। আনন্দময় জীবনের এই তো শুরু।
হলে ভর্তি হবার পরের সপ্তাহ থেকে ক্লাস শুরু হয়ে গেল। সকাল আটটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত একটানা ক্লাস। সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত লাঞ্চ ব্রেক। দেড়টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ল্যাব। ভয়াবহ চাপ। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। সায়েন্স পড়ার একি যন্ত্রণা! আর্টস-এর ছেলেরা দেখি মহাসুখে আছে। একটা দুটা ক্লাস করে চলে আসে। দুপুরে ঘুমায়। এদের দেখে ঈর্ষায় গা জ্বলে যায়। হায়! কি বোকামি করেছি। কেন আর্টস পড়লাম না?
আমাদের সময় রসায়ন বিভাগের নিয়ম ছিল সবচে জাঁদরেল শিক্ষকদের দেয়া হত প্রথম বর্ষের ক্লাস। তাঁরা ছাত্রদের ভিত তৈরি করে দিতেন। শক্ত ভিত তৈরি হলে পরবর্তী সময়ে তেমন সমস্যা হত না।
ক্লাসে যেতে হত তৈরি হয়ে। পাঠশালার মত অবস্থা। স্যাররা প্রশ্ন করে করে অস্থির করে ফেলতেন। ক্লাস থেকে ছাত্র বের করে দেয়া ছিল নিত্যদিনকার ঘটনা। কলেজের স্যারদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের একটা বড় ধরনের প্রভেদ প্রথম দিনেই স্পষ্ট হয়ে গেল। কলেজের স্যাররা যখন পড়াতেন তখন মনে হত, যে বিষয়টা তাঁরা পড়াচ্ছেন সে বিষয়টা তাঁরা নিজেরা খুব ভাল জানেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাররা দেখলাম শুধু যে জানেন তা না, এত ভাল করে জানেন যে ছাত্র হিসেবে ভয় ধরে যায়।।