…
খেলার কৌশল না জেনে বাড়ি যাওয়া সম্ভব না। আমার কৌতূহল প্রবল, আমার পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে। আমি নড়তে পারছি না। তিন টাকা দিয়ে কৌশল জানলাম। তবে কৌশল বলার আগে আমাকে তিন পীরের, মা-বাবার এবং ভাতের কসম কাটতে হল–এই কৌশল কাউকে বলা যাবে না। মুখলেসুর রহমান যা বলে আমি তাতেই রাজি। আমাকে জানতেই হবে। না জানলে আমি পাগল হয়ে যাব।
কৌশল জানার পর মনটা ভেঙে গেল। এত বড় ফাঁকি! মানুষকে ধোকা দেয়ার এত সহজ পদ্ধতি? আমি এমন বোকা! এই সহজ ধোঁকা বুঝতে পারলাম না? আমার তিনটা টাকা চলে গেল? তিন টাকায় ছদিন সকালের নাশতা হত। রাগে-দুঃখে আমার চোখে প্রায় পানি এসে গেল। মুখলেসুর রহমান সম্ভবত আমার মনের অবস্থা বুঝল। সে উদাস এবং খানিকটা বিষণ্ণ গলায় বলল, তুমি খেলার ফাঁকিটা দেইখা মন খারাপ করলা? ফাঁকির পেছনে বুদ্ধিটা দেখলা না? এই বুদ্ধির দাম হাজার টেকা।।
ম্যাজিসিয়ানের দার্শনিক ধরনের কথায়ও আমার মন মানল না। ফাঁকি হচ্ছে ফাঁকি। ফাঁকির পেছনে বুদ্ধি থাকুক আর না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না। মন খারাপ করে হোস্টেলে চলে এলাম ঠিকই কিন্তু আমার নেশা ধরে গেল। ছুটির দিন হলেই আমি খুঁজে খুঁজে মুখলেসুর রহমানকে বের করি। সে সাধারণত বসে গুলিস্তান এলাকায়। মাঝে মাঝে ফার্মগেটের কাছে। পরের বার তার কাছ থেকে শিখলাম দড়ি কাটার কৌশল। দড়ি কেটে দুখণ্ড করা হয়। নিমিষের মধ্যে সেই দড়ি জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়। কৌশল এত সহজ কিন্তু করা হয় অতি নিপুণ ভঙ্গিতে। দড়ি কাটার কৌশল শিখতে আমার পাঁচ টাকা চলে গেল। শিখলাম পয়সা তৈরির কৌশল। চার আনা, আট আনার মুদ্রা বাতাস থেকে তৈরি করে ঝনঝন। করে টিনের কৌটায় ফেলা হয়। এই কৌশল শিখতে দশ টাকা চলে গেল। তবে এই খেলা কাউকে দেখাতে পারলাম না। এই খেলা দেখানোর জন্যে পামিং জানা দরকার। পামিং হচ্ছে হাতের তালুতে কোন বস্তু লুকিয়ে রাখার কৌশল। আমার পামিং জানা নেই।
হোস্টেলে থাকার জন্য বাসা থেকে সামান্যই টাকা পাই। সেই সামান্য টাকার বড় অংশই চলে যাচ্ছে ম্যাজিকে। আমাকে মিথ্যা করে চিঠি লিখতে হয়–বই কিনতে হবে, টাকা দরকার। কলমটা হারিয়ে গেছে, নতুন কলম দরকার।
দুবছর পর আমি ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে বেরুলাম। বন্ধুমহলে আমি তখন ম্যাজিসিয়ান হুমায়ূন বলে পরিচিত। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ম্যাজিকের ভূত আমাকে ছাড়ল না। আমি তখন সিন্দাবাদ। ম্যাজিকের ভূত আমার ঘাড়ে বসে আছে। যতবার নামাতে যাই ততবারই সে আরো জোরে আমার গলা চেপে ধরে।
পুরানো ঢাকার আওলাদ হোসেন লেনে তখন একজন বৃদ্ধ ওস্তাদের সন্ধান পেয়েছি। বিহারের লোক। পামিং-এর রাজা বলা যায়। হাঁসের প্রকাণ্ড ডিম সে হাতের তালুতে লুকিয়ে ফেলে। তার এক ফুট সামনে বসে থাকা মানুষটিরও বোঝার উপায় নেই যে, সে প্রকাণ্ড একটা ডিম হাতের তালুতে লুকিয়ে রেখেছে। সে শুধু যে হাতের তালুতে ডিম লুকিয়ে রাখছে তাই না, এক হাত থেকে অন্য হাতে সেই ডিম দ্রুত চালান করে দিচ্ছে। চোখের পলকের চেয়েও তার হাতের গতি দ্রুত। তাকে আমি ডাকি ওস্তাদজী। লোকটা মহা ঠগ–আমার কাছ থেকে টাকা নেয় কিন্তু কিছু শেখায় না। বিরসমুখে বলে পামিং শেখানোর কিছু নাই–প্র্যাকটিস কর, প্র্যাকটিস।
সেই প্র্যাকটিস কিভাবে করব তাও বলে দেয় না। অনেক অনুরোধের পর আমার হাতের তালু খানিকক্ষণ টিপেটুপে বলে–তোমার হাত শক্ত। এই হাতে পামিং হবে না। বেহুদা পরিশ্রম। বরং ম্যাজিকের এক গল্প শোন।
ওস্তাদজী এমিতে বাংলাতেই কথা বলে তবে গল্পের তোড় এসে গেলে বিহারী কথা শুরু হয়, যার এক বর্ণও আমি বুঝি না। এক সময় ওস্তাদজীর স্ত্রী এসে কড়া ধমক লাগায় এবং আমার দিকে উগ্র চোখে তাকিয়ে বলে, নিকালো–আভি নিকালো। অত্যন্ত অপমানসূচক কথা কিন্তু আমি সেই অপমান গায়ে মাখি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে এক প্রতিভা প্রদর্শনীর আয়োজন হল। গান-নাচ-আবৃত্তি যে যা জানে। টিএসসিতে বিশাল ব্যবস্থা। আমিও উপস্থিত হলাম আমার ম্যাজিক প্রতিভা নিয়ে।
হল ভর্তি ছাত্র-শিক্ষক। বিরাট মঞ্চ। চোখ-ধাঁধানো আলো। ভয়ে আমার পা কাঁপছে। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। জিভ সীসার মত ভারী হয়ে গেছে। শুধু তাই না, সাইজেও মনে হয় খানিকটা বড় হয়ে গেছে। মুখ থেকে বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে। অনেক কষ্টে প্রথম আইটেম দেখালাম। ট্রায়াঙ্গুলার বাক্স থেকে কবুতর এবং মুরগি বের করার খেলা। এই বাক্স আমার নিজের না–অন্য এক জাদুকরের কাছ থেকে কুড়ি টাকায় ভাড়া করে এনেছি। প্রথম খেলা খুব জমে গেল। প্রচণ্ড হাততালি। আমার আড়ষ্টতা কেটে গেল। দ্বিতীয় আইটেম এন্টি গ্রেভিটি বটল। একটা বোতল মধ্যাকর্ষণ শক্তি উপেক্ষা করে শূন্যে ভাসবে। এটিও জমে গেল। আমার মনে হয় ছাত্র-ছাত্রীরা গান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল–আমার সামান্য ম্যাজিকে যে কারণে তাদের উল্লাসের সীমা রইল না। সেদিন খেলা ভালই দেখিয়েছিলাম। কারণ এক সপ্তাহ না যেতেই টিভি থেকে ডাক পেলাম। তারা একটা প্রোগ্রাম করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী নিয়ে অনুষ্ঠান, যেখানে আমার জন্যে পাঁচ মিনিট বরাদ্দ করা আছে। মিনিটে দশ টাকা হিসেবে আমি পাব পঞ্চাশ টাকা। আমার আনন্দ এবং বিস্ময়ের সীমা রইল না। ঠিক করলাম মুদ্রা তৈরির খেলা দেখাব। শূন্য থেকে মুদ্রা তৈরি করে টিনের কৌটায় ফেলা। ঝনঝন শব্দ হতে থাকবে–এক সময় কৌটা মুদ্রায় ভর্তি হয়ে যাবে।