আমি একশ চল্লিশ টাকা দিলাম।
স্যার চা খান।
না, চা খাব না।
আপনি আমার দোকান থেকে চা না খেয়ে যাবেন, তা তো হয় না।
চা এল। আমি চা খেয়ে খুশি মনে রওনা হলাম। মানুষকে অবিশ্বাস করলে ঠকতে হয়। যে সবাইকে বিশ্বাস করে সে কখনো ঠকে না।
আমার কি যে হল–অবিশ্বাসের সামান্য কণা মনে জন্মাল। অন্য একটা দোকানে এই জিনিসটির দাম জানতে চাইলাম। তারা বলল, একশ টাকা। আরো একটা দোকানে গেলাম। তারাও বলল, একশ। আমি হতভম্ব। তখন মনে হল–লোকটাকে অবিশ্বাস করেছি বলে ঠকেছি। অন্য কোথাও দাম জিজ্ঞে: না করলে তো কৈতাম না। চল্লিশ টাকা এমন বড় কিছু নয়।
একবার ভাবলাম, প্রথম দোকানে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করি–ভাই, এই কাজটা আপনি কেন করলেন? সামান্য চল্লিশটা টাকার জন্যে করলেন, নাকি আমাকে বোকা বানানোর জন্যে করলেন?
আমি লোকটির কাছে গেলাম না। প্রচণ্ড রাগ বুকে পুষে ঘরে ফিরে এলাম। রাতে বিছানায় ঘুমুতে গিয়ে মনে হল, ঐ লোক তার স্ত্রীর সঙ্গে নিশ্চয় হাসতে হাসতে গল্প করছে–আজ আমাদের দোকানে এসেছিল এক বোকা লেখক। ব্যাটাকে মাথা মুড়িয়ে ছেড়ে দিয়েছি। হা-হা-হা।
যে মানুষ ঈশ্বরের অংশ তার ভেতর এত ক্ষুদ্রতা কেন? আমি আরো অনেকের মত মানুষকে নিখুঁত প্রাণী হিসেবে ভাবতে ভালবাসি। যদিও খুব ভাল করেই জানি আমার ভেতর অসংখ্য খুঁত আছে। রাগ, লোভ, ঘৃণা, অহংকার সব শুধু যে আছে তাই না–অনেক বেশি পরিমাণে আছে, তবু কেন অন্যের ভেতর এইসব দেখলে এত কষ্ট পাই?
লেখালেখির সময়ও একই ব্যাপার–যে সব চরিত্র তৈরি করি তাদের মানবিক গুণই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তাদের চরিত্রের অন্ধকার অংশের কথা ভাবতে বা লিখতে ভাল লাগে না। লিখতে গেলে মনের উপর চাপ পড়ে।
মানুষকে বড় করে দেখার এই প্রবণতা কি দোষণীয়?
যে যেমন তাকে ঠিক তেমন করেই কি দেখা উচিত নয়? আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় মানব চরিত্রে এমন সব বড় দিক আছে যার স্পর্শে তার যাবতীয় দোষ, যাবতীয় ত্রুটি ঢাকা পড়ে যায়।
প্রাণী হিসেবে মানুষ অসম্ভব বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রধান লক্ষণ হচ্ছে, সে কখনো নিজের জীবন বিপন্ন করবে না। সে তার জীবনের মূল্য জানে। এই জীবনকে সে রক্ষা করবে। অথচ কি মজার ব্যাপার, অসম্ভব বুদ্ধিমান প্রাণী হয়েও মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকাণ্ড সব বোকামি করে। দাউদাউ করে একটা বাড়িতে আগুন জ্বলছে। বাড়ির ভেতর থেকে ছোট্ট একটা শিশুর কান্না শোনা যাচ্ছে। নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ শিশুর কান্না শুনে দৌড়ে আগুনের ভেতর ঢুকে পড়বে। ভয়াবহ বোকামি করে প্রমাণ করবে যে মানুষ শ্রেষ্ঠতম প্রাণী।
আমাদের নানার বাড়িতে নসু বলে একটা লোককে ছোটবেলায় দেখেছিলাম। তার সমস্ত শরীর ঝলসানো। সে আগুনে আটকা পড়া একটা বিড়াল ছানাকে বাঁচাতে গিয়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল। সবাই তাকে ডাকতো বোকা নসু। কিন্তু সেই বোকা ডাকের সঙ্গে কি গভীর মমতাই না মেশানো থাকতো!
ছোটবেলায় আমি ভেবেছিলাম, নসু মামা বোধ করি খুব বিড়াল পছন্দ করেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি দাঁত-মুখ কুঁচকে বললেন, দূর ভাইগনা। বিলাই আমার দুই চউক্ষের বিষ।
আশ্চর্যের ব্যাপার, এই দুচোখের বিষের বাচ্চা বাঁচানোর জন্যেও আগুনে ঝাপিয়ে পড়া যায়। মানুষ বলেই সে পারে। মানুষকে চেষ্টা করে মহৎ হতে হয় না, মহত্ত্ব নিয়েই সে জন্মেছে।
আমার মন যখন বিক্ষিপ্ত থাকে তখন কিছু কিছু লেখকের রচনা পাঠ করি যা আমাকে শান্ত হতে সাহায্য করে। মার্কিন ঔপন্যাসিক জন স্টেইনবেক তেমনি একজন লেখক। মানুষের শুভবুদ্ধির প্রতি তাঁর আস্থা, মানুষের প্রতি তাঁর সীমাহীন মমতা আমাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে।
১৯৫২ সনে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে জন স্টেইনবেক যে ভাষণ দিয়েছিলেন আমার কাছে সে ভাষণ দৈববাণীর মত মনে হয়। স্টেইনবেক বলছেন–আমি মনে করি যে লেখক মানুষের নিখুঁত ও ত্রুটিহীন হয়ে উঠবার সম্ভাবনায় আস্থা স্থাপন করেন না–সাহিত্যের প্রতি তাঁর কোন আনুগত্য নেই। সাহিত্য সদস্য হবার কোন যোগ্যতা তাঁর নেই।
এই মহান লেখক মানুষের ত্রুটিগুলি এত মমতায় এঁকেছেন যে পড়তে পড়তে বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। মনে হয়, বিশ্বাস হারানোর সময় এখনো আসে নি। কখনো আসবেও না।।
আমার যখন রাতজাগা রোগ হয় তখন এই লেখকের দুটি বই খুব আগ্রহ করে পড়ি–একটি হল ক্যানারী রো। কয়েকজন ভবঘুরে অলস যুবকের গল্প। অন্যটি টরটিলা ফ্ল্যাট। বড়ই মজার, বড়ই রহস্যময় উপন্যাস। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি, যে গ্রন্থের জন্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পান–গ্রেপস অব র্যাথ তা আমার পড়তে একেবারেই ভাল লাগে নি। একবার শুধু পড়েছি। তাও কষ্ট করে।
এই মহান লেখক তাঁর আত্মজীবনীতে খুব মজা করে একটা ঘটনা লিখেছেন। হাতের কাছে বইটি নেই। কাজেই হুবহু অনুবাদ করতে পারছি না–ঘটনাটা বলি। যুবক বয়সে স্টেইনবেকের খুব ইচ্ছে হল আমেরিকার এক মাথা থেকে পায়ে হেঁটে অন্য মাথায় যাবেন। কাঁধে হেভার স্যাক নিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় যাত্রা শুরু করলেন। সারাদিন হাঁটেন। রাতে কোন না কোন বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। গৃহকর্তা জিজ্ঞেস করেন, তোমার উদ্দেশ্য কি? যাচ্ছ কোথায়?