মেট্রিক পরীক্ষার পর তিন মাস সময় পাওয়া যায়। এই তিন মাস রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই–আমি তিন মাস নষ্ট করলাম জ্যোতিষী এবং এস্ট্রনমির বই পড়ে পড়ে। বাসায় এ-জাতীয় বই-এর কোন অভাব ছিল না। এক সময় হাত দেখাও শুরু হল–হাত দেখা, সেই সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিবেচনা করা। দ্বিতীয়টি বেশ কঠিন। কিছুদিন চেষ্টা করে বাদ দিয়ে দিলাম। হাত দেখা বজায় রইল। অল্পদিনেই বুঝে গেলাম–বড় পামিস্ট হিসেবে নাম করা অত্যন্ত সহজ কাজ। হাত দেখাতে যে আসে সে নিজের সম্পর্কে কিছু কিছু জিনিস শুনতে চায়। কি শুনতে চায় তা নিজের অজান্তেই প্রকাশ করে ফেলে। যে সব জিনিস শুনতে চায় সে সব শুনিয়ে দিলেই সে পামিস্ট সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।
মহসিন হলে থাকাকালীন সময়ে আমার হাত দেখা বিদ্যার (!!) পূর্ণ বিকাশ ঘটল। দূর-দূর থেকে অচেনা মানুষজনও আসতেন এবং বিনীত গলায় বলতেন, আপনার নাম শুনে এসেছি–একটু যদি কাইন্ডলি। এঁদের কঠিন মুখে ফিরিয়ে দিতাম। তাই নিয়ম। কয়েকবার ফিরিয়ে দিতে হবে। তারপরেও আসবে তখন একদিন হাত দেখা হবে। যে সব কথা ভদ্রলোক শুনতে চাচ্ছেন তার সবই আমি তাকে শুনিয়ে দেই এবং অভিভূত করে বিদায় দেই, কাজটা খুব কঠিন না। নমুনা দিচ্ছি–
আমি : আপনাকে সবাই ভুল বুঝে। আপনি আসলে কি কেউ জানে না।
ভদ্রলোক : ঠিক বলেছেন। সবাই ভুল বুঝে (উদাস হয়ে গেলেন। একই সঙ্গে খুশি। সব মানুষই চায়–তার মধ্যে রহস্য থাকুক।]
আমি : সবচে বেশি ভুল বুঝে আপনার অতি প্রিয়জনরা।
ভদ্রলোক : খুব কারেক্ট অবজারভেশন। [আরো উদাস, এবং দুঃখি। তবে এই দুঃখে কিছুটা আনন্দ মেশানো।]
আমি : আপনি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত উদার যদিও ভাব করেন যে আপনি উদার নন।
ভদ্রলোক : এটা ভাই আপনি দারুণ সত্যি কথা বললেন। ভেতরের কথা বলে ফেলেছেন।
[দারুণ খুশি, সবাই চায় নিজেকে উদার ভাবতে।]
আমি ও মানুষের প্রতি আপনার মমতা অপরিসীম। শুধু মানুষ না পশু পাখি এদের প্রতিও আপনার অসীম মমতা।
ভদ্রলোক : এটা যখন বললেনই তখন আপনাকে একটা গল্প বলি। বৎসর খানিক আগের কথা। নিউ মাকের্টে গিয়েছি…
[lম্বা গল্প ফেঁদে বসলেন যেখানে পশুপ্রেমের ব্যাপার আছে।]
আমি : আপনার ভেতর অনুশোচনার ব্যাপারটা অত্যন্ত প্রবল। কোন একটা অন্যায় করবার পর তীব্র অনুশোচনায় আপনি আক্রান্ত হন। এমনও হয়েছে যে অতি সামান্য অন্যায় কিন্তু সারারাত আপনার ঘুম হল না।
ভদ্রলোক : [ অভিভূত। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। ধরা গলায় বললেন–] আমার ফ্যামিলি লাইফ সম্পর্কে বলুন।
বলার ভঙ্গি থেকে ধরতে হবে লোকটি পারিবারিক জীবনে সুখী কি সুখী নয়। শতকরা আশি ভাগ সম্ভাবনা–অসুখী। সুখী মানুষ জ্যোতিষী খুঁজে বেড়ায় না। অসুখী হলে অসুখের কারণটা অর্থনৈতিক কি-না তা লোকটির কাপড়-চোপড় দেখে ধরতে হবে। যদি দেখা যায় কারণ অর্থনৈতিক নয় তাহলে বুঝতে হবে সমস্যা অন্য জায়গায়।
আমি : ভাই কিছু মনে করবেন না। আপনার হাত দেখে মনে হচ্ছে। পারিবারিক জীবনে আপনি অত্যন্ত অসুখী, যদিও বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না। কেন অসুখী তাও আপনার হাতে আছে। বেশ পরিষ্কার ভাবেই আছে, কিন্তু স্যরি। আমি বলতে চাচ্ছি না। এই বিষয়ে আমি কিছু বলব না। দয়া করে আমাকে জোর করবেন না।
আমাকে তখন আর কিছু বলতে হয় না। ভদ্রলোক নিজেই তখন হড়বড় করে তার জীবন ইতিহাস বলতে থাকেন। এই ব্যাপার আমি একবার না, অসংখ্যবার লক্ষ্য করেছি। মানুষগুলি জেনেশুনে প্রতারিত হবার জন্যে আসে। প্রতারিত হয় এবং হাসিমুখে ফিরে যায়। তার জন্যে আমি তেমন কোন গ্ৰানিবোধ করি না। তার প্রধান কারণ, এর মধ্যে কোন অর্থ জড়িত নয়। হাত দেখার জন্যে আমি কোন টাকা নেই না। এতটা নামা আমার পক্ষে সম্ভব না। দ্বিতীয় কারণ, পুরো ব্যাপারটায় আমি খুব মজা পাই। মানব চরিত্রের বিচিত্র সব দিক ধরা পড়ে।
অনেকেই হয়ত বলবেন–আপনি হাত দেখতে জানেন না বলেই আজেবাজে কথা বলে মানুষকে ধোকা দেন। যারা জানে তারা দেয় না। হাতে যা আছে তাই বলে। তাঁদের জন্যে আমার একটা গল্প আছে–বছর ছয়েক আগের কথা। সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকার অফিসে গিয়েছি। গল্প করছি। রোববার পত্রিকার সম্পাদক কবি রফিক আজাদের সঙ্গে। তখন বাংলাদেশের একজন নামী হস্তরেখাবিশারদ পত্রিকা অফিসে ঢুকলেন। তাঁর নাম করছি না। তাতে তাঁর রমরমা ব্যবসার ক্ষতি হতে পারে।
রফিক আজাদ আমাকে দেখিয়ে বললেন, উনার হাতটা দেখুন তো।।
হস্তরেখাবিশারদ আমাকে চিনলেন না। চেনার কথাও না। তখন পত্র পত্রিকায় আমার কোন ছবি ছাপা হত না। তিনি গভীর মনোযোগে হাত দেখলেন–এবং বললেন,
আপনি লেখালেখি করেন।
সবাই চমৎকৃত হল। আমি হলাম না। পত্রিকার অফিসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। সঙ্গত কারণেই ধরে নেয়া যায় আমি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। আমি তাঁকে কনফিউজ করবার জন্যে খুব শংকিত গলায় বললাম–আমার পড়াশোনা কতদূর হবে একটু দেখুন।
হস্তরেখাবিশারদ আমার টোপ গিললেন এবং আমার করুণভাবে বলার ভঙ্গি থেকে ধরে নিলেন–পড়াশোনার অবস্থা শোচনীয়।
আপনার রবির ক্ষেত্র বেশ দুর্বল। তাছাড়া বৃহস্পতির ক্ষেত্রও তেমন ডেভেলপড নয়। ব্রেক অব স্টাডি আছে।