আমি এই জীবনে অনেক মধুর সংগীত শুনেছি। কর্নেগী হলে শুনেছি পৃথিবী-শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞের কনসার্ট–মোজার্টের ফিফথ সিম্পোনী। লাসভেগাসে লেবোরেটরীর পিয়ানো শুনেছি বিথোভেন–কিন্তু সেদিনের কিছু অখ্যাত গ্রাম্য বাজনাদারদের বাজনার মত মধুর সংগীত এখনো শুনি নি–আর যে শুনব সে আশাও কম।
পশু-প্রেমিক
আমার এক বন্ধু আছেন–পশু-প্রেমিক। রাস্তায় কুকুর কাঁদছে কুঁ-কুঁ করে, তিনি হয়ত যাচ্ছেন রিকশায়; রিকশা থামিয়ে ছুটে যাবেন। চোখ কপালে তুলে বলবেন, হল কি তোর? এই আয়, তু তু তু। তাঁর পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা বিড়ালের গায়ে গরম মাড় ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি সেই বিড়াল নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে গেলেন। ইন্টার্নী ডাক্তার বললেন, এখানে কেন এনেছেন? পশু হাসপাতালে নিয়ে যান।
তিনি বললেন, পশু হাসপাতাল কোথায় আমি চিনি না। প্লীজ ফার্স্ট এইড দিন, আমি পরে পশু হাসপাতাল খুঁজে বের করব।
ডাক্তার ফার্স্ট এইড দিতে রাজি নন।
আমার বন্ধু ফার্স্ট এইড না নিয়ে যাবেন না। চিৎকার, চেঁচামেচি, হৈচৈ। চারদিকে লোক জমে গেল। আমার বন্ধু শার্টের হাতা গুটিয়ে ডাক্তারকে মারতে গেলেন। কেলেঙ্কারি অবস্থা।
মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি আমার এই বন্ধু চরম উদাসীন। একবার এক পকেটমার ধরা পড়েছে। কিল-ঘুসি-লাথি মেরে তার অবস্থা এমন যে এখন যায় তখন যায় অবস্থা। সে ক্ষীণ স্বরে বলছে–আমারে একটু পানি দেন। এক ফোঁটা পানি।
আমার বন্ধু কঠিন গলায় বললেন, হারামজাদার মুখে কেউ প্রস্রাব করে দিন তো।
তার বাসায় ভিক্ষা চাইতে এসে ভিখিরি প্রচণ্ড লাথি খেয়েছিল। তার ক্লাস টেনে পড়া মেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির ছেলের সঙ্গে গল্প করছিল। এটা জানার পর তিনি মেয়েকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। আধ ঘণ্টা পর মেয়ে যখন কাঁদতে কাঁদতে বের হল তখন দেখা গেল তার মাথার সব চুল কেটে ফেলা হয়েছে। অল্প কিছু চুল কোট ব্রাশের মত খাড়া হয়ে আছে। আমার এই বন্ধুর ভালবাসা পশু সমাজের জন্য।
আমি আমার বন্ধুর মত নই। কুকুরের প্রভুভক্তির অসংখ্য গল্প জানা থাকা সত্ত্বেও কুকুর দেখলে ভয় ছাড়া অন্য কোন মানবিক আবেগ আমি বোধ করি না। বিড়াল প্রাণী হিসেবে খুব সুন্দর। সেই বিড়ালকে একবার দেখলাম রক্তাক্ত ইঁদুর মুখে নিয়ে ঘুরছে। বিড়ালের ধবধবে শাদা মুখে লাল রক্তের ধারা। আমি সেই থেকে বিড়াল পছন্দ করি না।
আমার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে বিড়ালের কোন মাথাব্যথা থাকার কথা না। তারা যখন-তখন আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় আসে। খাবার টেবিল থেকে মাছ নিয়ে পালিয়ে যায়। আদর্শ বিড়ালের মত মাছের কাটায় তারা সন্তুষ্ট নয়। আমি বিড়াল দেখলেই দূর-দূর করি। ওরা নানান ভাবে আমার সঙ্গে খাতির করার চেষ্টা করে। হয়ত বই পড়ছি–চুপি চুপি এসে পায়ের সঙ্গে গা ঘসে গেল। লাথি মারবার আগেই পালিয়ে গেল।
স্ত্রীরা স্বামীদের অধিকাংশ অভ্যাস গ্রহণ করে ফেলে (যদিও তারা কখনো তা স্বীকার করে না)। গুলতেকিনও সেই ফমূলায় বিড়াল অপছন্দ করে। আমাদের যৌথ প্রচেষ্টায় বিড়ালের জন্য এই বাড়ি মোটামুটি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। এরা তবু আশা ছাড়ে না। মাঝে-মধ্যে আসে। দুঃখিত চোখে আমাদের দেখে চলে যায়।
এক রাতের ঘটনা। বসে বসে লিখছি। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হওয়ায় শীত শীত লাগছে। আমি গুলতেকিনকে বললাম একটা চাদর দিতে। সে চাদরের জন্যে কাবার্ড খুলে চেঁচিয়ে উঠল। এক অতি রুগণ বিড়াল কাবার্ডের ভেতর বাচ্চা দিয়ে বসে আছে। এতটুকু টুকুন চার বাচ্চা কুঁ কুঁ শব্দ করছে। কাবার্ডের সমস্ত কাপড় নোংরা। বিশ্রী অবস্থা!
গুলতেকিন বলল, এখন কি করব? আমি বললাম, রাতটা কাটুক। ভোরে ফেলে দেয়া যাবে। খুব পাষাণহৃদয় মানুষের পক্ষেও বাচ্চাসহ একটা বিড়াল ফেলে দেয়া কঠিন। আমাদের এই অপ্রিয় দায়িত্ব পালন করতে হল না।
আমার ছোট মেয়ের বান্ধবী পাশের ফ্ল্যাটের জেনিফার ভোর বেলাতেই একটা জুতার বাক্স নিয়ে উপস্থিত। সে গম্ভীর গলায় আমাকে বলল, চাচা, আমাদের বিড়ালটা না-কি আপনাদের বাসায় বাচ্চা দিয়েছে?
একটা বিড়াল বাচ্চা দিয়েছে জানি। তোমাদের বিড়াল কি-না তাতো জানি না। তোমাদের বিড়াল চেনার উপায় কি?
ওর নাম লুসিয়া।
নামে তো মা ঠিক চিনতে পারছি না।
ওর খুব স্লীম ফিগার।
স্লীম ফিগার হলে তোমাদেরই বিড়াল। তুমি পরীক্ষা করে দেখ। কাবার্ডের ভেতর আছে।
কাবার্ড খোলা হল। লুসিয়াকে পাওয়া গেল না। বাচ্চা চারটা আছে। এখনো চোখ ফুটে নি।
জেনিফার বলল, চাচা, আমি এদের আমাদের বাসায় নিয়ে যাব।
আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বললাম, অবশ্যই নিয়ে যাবে মা, অবশ্যই নিয়ে যাবে। তোমাদের বিড়াল অন্যের বাসায় বাচ্চা মানুষ করবে এটা কোন কাজের কথা না। সম্মান হানি হবার মত কথা।
জেনিফার জুতার বাক্সে বিড়ালের বাচ্চা তুলে নিয়ে গেল। আমি নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, বাঁচা গেল।
সে রাতের ঘটনা। বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে আমি পরীক্ষার খাতা দেখছি। অনেক খাতা জমে আছে। প্রতিজ্ঞা করে বসেছি ত্রিশটা খাতা না দেখে ঘুমুতে যাব না। খাতাগুলি দেখতে খুব সময় লাগছে। রাত একটার মত বেজে গেল। পুরো বাড়ি ঘুমে অচেতন। আমি জেগে আছি। ফ্লাক্স ভর্তি চা আমার সামনে রেখে দেয়া।