সঙ্গের মৌলানা সাহেব সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের দুজনকে পীর সাহেবের কাছে উপস্থিত করলেন। পীর সাহেব চারদিকে কিছু লোকজন নিয়ে গল্প করছেন। কাছে যাওয়ার সাহস হল না। শুনলাম, মৌলানা পীর সাহেবকে নিচু গলায় কিছু বলছেন এবং পীর সাহেব রেগে যাচ্ছেন। সব কথা বুঝতে পারছি না। পীর সাহেব বেশির ভাগ কথার জবাব দিচ্ছেন উর্দুতে। আমার বাবার প্রসঙ্গে কি কথা যেন বলা হল। পীর সাহেব বললেন, আমি এই লোকের কথা জানি। বিরাট দেশদ্রোহী। ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যাও যাও, তুমি চলে যাও।
মৌলানা সাহেব আরো নিচু গলায় সম্ভবত আমাদের দুভাই সম্পর্কে কিছু বললেন। পীর সাহেব ভয়ংকর রেগে বললেন–না, না। এদের কেন এখানে এনেছ?
মৌলানা সাহেব আমাদের নিয়ে ফিরে চললেন। কি কথাবার্তা তাঁর হয়েছে তিনি কিছুই ভেঙে বললেন না। নৌকায় করে ফিরছি এবং প্রার্থনা করছি খুব তাড়াতাড়ি যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে মিলিটারীরা গানবোট নিয়ে বের হয় না। ভোলা নৌকার পাটাতনে বসে আছি। ভরা জোয়ার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ মাঝি বলল–দেহেন দেহেন। তাকালাম। দুটি মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। এমন কোন দৃশ্য নয় যে অবাক বিস্ময়ে দেখতে হবে। খুবই সাধারণ দৃশ্য। রোজই অসংখ্য দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে যায়। শকুনের পাল দেহগুলির উপর বসে বসে ঝিমোয়। নরমাংসে তাদের এখন আর রুচি নেই। কিন্তু আজকের মৃতদেহ দুটির উপর শকুন বসে নেই। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। চোখ ফেরাতে পারছি না। সবুজ শার্ট গায়ে দেয়া ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের একজন যুবকের মৃতদেহ। তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে সাত আট বছরের একটি বালিকা। বালিকার হাত ভর্তি লাল কাঁচের চুড়ি। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে হয়ত পরম নির্ভরতায় এই বালিকা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।
এখন আমরা বাস করছি স্বাধীন দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশ। এই দেশের সবচে সম্মানিত, সবচে বড় পদকটির নাম–স্বাধীনতা পদক। বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মুনীর চৌধুরী, রনদা প্রসাদ সাহা, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এই পদক পেয়েছেন।
১৯৮০ সনে, মুক্তিযুদ্ধের ন বছর পর মহান বিজয় দিবসে রেডিও ও টেলিভিশনের খবরে শুনলাম–স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে–সর্ষিনার পীর মৌলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে।
হায়, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি?
বিয়ের ঘটকালী
বাঙালি মাত্রই প্রবল উৎসাহের সঙ্গে একটি কাজ করে–বিয়ের ঘটকালী। যে মানুষটির কোন কাজে উৎসাহ নেই, সাপ্তাহিক বাজারে যান না, ঈদের জামা কেনার জন্যে বাচ্চাদের হাত ধরে বের হন না, তিনিও বিয়ের ঘটকালীতে প্রবল উৎসাহ বোধ করেন। সম্ভবত ঘটকালী করতে গিয়ে নিজের বিয়ের কথা মনে পড়ে, প্রথম জীবনের সুখস্মৃতিতে নস্টালজিক হবার সুযোগ ঘটে বলেই এত উৎসাহ।
আমি নিজে খুব আগ্রহ করে এ-রকম একটি বিয়ে দেই। গ্রামের একটি কলেজে পরীক্ষা নিতে গিয়ে একটি রূপবতী তরুণীকে আমার খুব পছন্দ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক তখন পিএইচ.ডি. করতে কেমব্রীজ যাচ্ছে। বউ সঙ্গে নিয়ে যাবার সুযোগ আছে। সে পাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি তাকে ডেকে বললাম, একটা ভাল মেয়ে দেখেছি। ঠিকানা দিচ্ছি, তুমি মেয়েটিকে দেখে এসো।
সে অবাক হয়ে বলল, আপনি যেখানে ভাল বলছেন সেখানে আমার দেখার কি দরকার? আপনি ব্যবস্থা করে দিন। আপনি যাকে বিয়ে করতে বলবেন আমি তাকেই বিয়ে করব।
আমার প্রতি তার আস্থা দেখে শংকিত বোধ করলাম। চিঠি লিখলাম মেয়ের বাবাকে। মেয়ের বাবা রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠির জবাব পাঠালেন। চিঠির ভাষা
এরকম–
পরম পূজনীয় স্যার,
ভগবানের আশীর্বাদস্বরূপ আপনার পত্র পাইয়াছি। আপনি আমার জ্যেষ্ঠা কন্যার জন্য পাত্র দেখিয়াছেন–আপনার পছন্দের পাত্রকে আমার দেখার কোনই কারণ নেই। আপনি যদি রাস্তার কোন অন্ধ ভিক্ষুককে আমার কন্যার জন্য স্থির করেন–ভগবানের শপথ, আমি তাহার হাতেই কন্যা তুলিয়া দিব। আমার কন্যাও তাহাতে কোন অমত করিবে না।
শুধু শ্রীচরণে একটি অনুরোধ–বিবাহ অনুষ্ঠানে আপনাকে উপস্থিত থাকিতে হইবে এবং কন্যা আপনাকে সম্প্রদান করিতে হইবে।
এ কি সমস্যায় পড়া গেল! কেউ কাউকে দেখল না–এক চিঠিতে বিয়ে? তারপর যদি দেখা যায় তেলে-জলে মিশ খাচ্ছে না তখন কি হবে? স্বামী-স্ত্রীর অশান্তির দায়ভাগের সবটাই কি আমাকে নিতে হবে না?
বিবাহ অনুষ্ঠান গ্রামে হবে। অনেক দূরের পথ–লঞ্চে করে যেতে হয়। আমি তিন কন্যা এবং কন্যাদের মাকে নিয়ে উপস্থিত হলাম। নিজে বিয়ে দিচ্ছি সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকব না তা হয় না। তাছাড়া হিন্দু বিয়ের অনুষ্ঠান খুব সুন্দর হয়। বাচ্চারা দেখে আনন্দ পাবে। আগে কখনো দেখেনি–।
শেষরাতের দিকে লগ্ন।
লগ্ন পর্যন্ত পৌঁছার আগেই ভয়াবহ সব ঝামেলা হতে শুরু করল। ঝামেলার প্রকৃতি ঠিক স্পষ্ট হল না।–রাত বারোটার সময় বর এসে আমাকে কানে কানে বলল, স্যার, বিয়ে করব না।
সেকি?
পালিয়ে যাব। বন্ধু বান্ধবরা তা-ই বুদ্ধি দিচ্ছে। এরা অবশ্যি পাহারা বসিয়ে দিয়েছে। ধরতে পারলে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবে।
সত্যি পালাবে না-কি?