আমি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এই ভয় তো অকারণ ভয় নয়। ভয় পাওয়ার আপনার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। আমি জানতে চাচ্ছি, ভয় পাওয়ার মত কিছুই ঘটে নি অথচ আপনি ভয়ে দিশাহারা হয়ে গেলেন।
কি সব পাগলের মত কথা যে আপনি বলেন–ভয় পাওয়ার মত কিছু না ঘটলে আমি শুধু শুধু ভয় পাব কেন?
অনিবার্য নিয়তির সামনে দাঁড়ালে তীব্র ভয় এক সময় এক ধরনের প্রশান্তিতে পরিণত হয় বলে আমার ধারণা। ১৯৭১ সনে পাক মিলিটারী আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল। তীব্র ভয়ে আমি অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরপর আমার সব ভয় দূর হয়ে যায়। এক ধরনের প্রশান্তি বোধ করতে থাকি। প্রচণ্ড জ্বরে কাতর থাকার পর হঠাৎ জ্বর সেরে গেলে যেমন ক্লান্ত অথচ শান্তি শান্তি ভাব হয় অনেকটা সেরকম।
কে জানে ফঁসির আসামীও গলায় দড়ি পরাবার আগে এ-রকম বোধ করে কি-না। জানবার উপায় নেই। জল্লাদ নিশ্চয়ই দড়ি পরাবার আগে জিজ্ঞেস করে না, ভাই আপনার কেমন লাগছে?
অনিবার্য নিয়তি যে কত বিচিত্র ধরনের হতে পারে তার একটি ঘটনা বলি।
ঘটনাটা ঘটে রামপুরা রেলওয়ে ক্রসিং-এ আজ থেকে দুবছর আগে। ভোরবেলা মর্নিং ওয়াকের দলের একটি অংশ রেল লাইন ধরে হাঁটেন। তেমনি একজন মর্নিং ওয়াকে বের হয়েছেন। বয়স চল্লিশের মত। পায়ে স্যান্ডেল। রেল ক্রসিং পার হতে গিয়ে পায়ের পাতা কেমন করে জানি লাইনে আটকে গেল। এমন কোন জটিল ব্যাপার না। পা টেনে বের করা যাবে। আশ্চর্য ব্যাপার! ভদ্রলোক পা টেনে বের করতে পারলেন না। আশেপাশে লোক জমে গেল। তারাও চেষ্টা করল–লাভ হল না। কিছুতেই পা বের হচ্ছে না।
ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল–চিটাগাংগামী আন্তঃনগর ট্রেন প্রভাতী ছুটে আসছে। ভদ্রলোক প্রাণপণ চেষ্টা করলেন এবং এক সময় বুঝলেন চেষ্টা করে। লাভ নেই।–ছুটে আসছে অনিবার্য নিয়তি। তিনি পা পেতে দিয়ে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
এই ভদ্রলোকের মত আমরাও সবাই কি অনিবার্য নিয়তির জন্যে অপেক্ষা করছি না?
ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠি
ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠি পেয়েছি। হাতের লেখা যেমন চমৎকার, ইংরেজিও খুব সুন্দর। চিঠির শেষে নাম নেই, শুরুতেই তার জন্যে পত্র লেখিকা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। নিজের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেছেন–আমি মোটামুটি সম্মানজনক একটি চাকরি করছি। আমার বয়স ৪০। আমার আদি নিবাস বিহার প্রদেশে। মোহাজের হয়ে বাবা-মা-ভাইবোন সহ ১৯৫০ সনে তদানীন্তন পাকিস্তানের সৈয়দপুরে চলে আসি।
একটি দীর্ঘ চিঠি। ভদ্রমহিলা জানাচ্ছেন, তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমার এক সাক্ষাৎকারে পড়েছেন যে, আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘ একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা নিয়েছি। তিনি চাচ্ছেন যেন সেই উপন্যাস একপেশে না হয়। যেন বিহারী মোহাজেরদের কথা লেখা হয়–যারা একটি দেশ ছেড়ে অন্য একটি দেশে এসেছিল, সেই দেশও তাদের রইল না। পাকিস্তানও তাদের দেশ নয়। এখন তারা এমন এক মানবগোষ্ঠী যাদের কোন দেশ নেই।
এই পত্ৰলেখিকা জেনেভা ক্যাম্পে তিন মাস ছিলেন। তিনি সেই তিন মাসের অভিজ্ঞতা এবং জেনেভা ক্যাম্পে আসার আগের অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাঁর এবং তাঁর পরিবারের অভিজ্ঞতা খোলাখুলি বর্ণনা করেছেন। যেই অভিজ্ঞতার কিছু কিছু অংশ ভয়াবহ। বর্ণনাতীত।
চিঠির শেষ পর্যায়ে তিনি লিখছেন–প্রিয় লেখক, আমি কিছুই আপনার কাছে গোপন করি নি। সব লিখলাম এই আশায়, যখন আপনি লিখবেন তখন আমাদের কথাও মনে রাখবেন। আপনারা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছেন–আমরা কি পেলাম?
চিঠিতে কোন ঠিকানা নেই বলে আমি চিঠির জবাব দিতে পারি নি। এই লেখায় জবাব দিচ্ছি। জানি না তিনি পড়বেন কি-না। না পড়লেও আমার মনের শান্তির জন্যে চিঠিটার জবাব দেয়া দরকার।
আমি ভদ্রমহিলাকে জানাচ্ছি যে, তাঁর চিঠি আমি গভীর মমতা এবং গভীর বেদনার সঙ্গে পড়েছি। যে অন্যায় তাঁর উপর এবং তাঁর পরিবারের উপর করা হয়েছে। তার জন্যে আমি এদেশের মানুষের হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
সেই সঙ্গে তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, সমগ্র জাতির উপর যখন পাকিস্তানী মিলিটারী নির্মম অত্যাচার শুরু করেছে তখন মোহাজের বিহারীদের আমরা পাশে পাই নি। তারা যোগ দিয়েছেন হানাদার বাহিনীর সঙ্গে। অথচ তাঁরা বাংলাদেশের জল-হাওয়ায় বড় হচ্ছেন। মাটি আমাদের মা। তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন মায়ের সঙ্গে। এই বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি তো পেতেই হবে। ভয়াবহ দুঃসময়ে সব এলোমেলো হয়ে যায়। একজনের অপরাধে দশজন নিরপরাধী শাস্তি পায়। আমরা বাঙালিরা কোন অপরাধ না করেই কঠিন শাস্তি পেলাম। তাঁরাও খানিকটা পেয়েছেন। আমাদের চরম দুঃসময়ের কথা মনে করে তাঁরা তাদের পুরানো ব্যথা ভোলার চেষ্টা করবেন–এই কামনাই করছি।
দেশ স্বাধীন হয়েছে অনেক দিন হল। পদ্মা, মেঘনায় অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে–১৯৭১-এর স্মৃতি সেই বিপুল জলরাশি মুছে ফেলতে পারে নি। পত্রলেখিকা তাঁর জীবনের ভয়ংকর কিছু সময়ের কথা লিখেছেন–আমিও খানিকটা লিখলাম। এই লেখাটায় ঈশপের গল্পের মত শেষের দিকে একটু চমক আছে। আশা করি পত্র–লেখিকা সেই চমকটি ধরতে পারবেন এবং আমার দুঃখের তীব্রতা খানিকটা হলেও বুঝবেন–