একবার নর্থ ডাকোটা থেকে গাড়িতে করে সিয়াটল যাচ্ছি, পথে মন্টানায় রাত্রিযাপনের জন্য থামলাম। চারদিকে পাহাড়ঘেরা সমতলভূমি। বাচ্চাদের হোটেলে শুইয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। রূপার থালার মত প্রকাণ্ড চাঁদ উঠেছে। অপূর্ব জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না ভেঙে আলো-আঁধারের অপূর্ব নকশা তৈরি হয়েছে পাহাড়ের গায়ে। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মহান সৌন্দর্যের মুখোমুখি হলে এক ধরনের তীব্র হাহাকার মনের ভেতরে আপনা আপনি জন্মায়–সুন্দরের উৎস সন্ধানে ব্যাকুলতা জাগে।
সৌন্দর্য দেখে দেখে জীবন কাটিয়ে দিলাম, এই সুন্দরের জন্ম কোথায়, কোন দিন তার খোঁজ করলাম না। এই জীবনে সম্ভব হল না–হায়! অন্য কোন জীবনও তো নেই, থাকলে চেষ্টা করা যেত।
ছোটবেলায় আমাদের মীরাবাজারের বাসায় একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ বেড়াতে আসতেন। আমার বাবা-মা দুজনই ছিলেন তাঁর ভক্ত। এই চিরকুমার মানুষটি না-কি মহাপুরুষ পর্যায়ের। ঘুরে বেড়াতেন খালি পায়ে, অতি তুচ্ছ বিষয়ে হা-হা করে হাসতেন। তখন আমার ধারণা হল–মহাপুরুষদের খালি পায়ে থাকতে হয়, অকারণে হাসতে হয়। এক সন্ধ্যার কথা তিনি বেড়াতে এসেছেন। মা বললেন, আপনি খুব ভালো দিনে এসেছেন, আমার কাজলের জন্যে একটু প্রার্থনা করুন। আজ কাজলের জন্মদিন।
তিনি আমাকে টেনে কোলে তুলে বললেন–গা দিয়ে ঘামের গন্ধ বেরুচ্ছে, কি রে ব্যাটা, গায়ে ঘামের গন্ধ কেন? এই বলেই চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করলেন, পরম করুণাময়, এই ছেলের অন্তর থেকে তুমি অন্ধকার দূর কর।
তাঁর প্রার্থনা ঈশ্বর গ্রহণ করেন নি। আমার অন্তরে এমন সব অন্ধকার আছে যা দেখে আমি নিজেও মাঝে মাঝে ভয়ে চমকে উঠি। কাউকে সেই অন্ধকার দেখতে দেই না। আলোকিত অংশটাই দেখতে দেই, কারণ এই আঁধার আমার আপন আঁধার। আমার নিজস্ব অনন্ত অমর।
হুমায়ূন আহমেদ
১৩ই নভেম্বর ১৯৯১
ঝোঁকের মাথায়
এই জীবনে বেশির ভাগ কাজই আমি করেছি ঝোঁকের মাথায়। হঠাৎ একটা ইচ্ছে হল, কোনদিকে না তাকিয়ে ইচ্ছাটাকে সম্মান দিলাম। পরে যা হবার হবে। দুএকটা উদাহরণ দেই–আমাদের সময় সায়েন্সের ছেলেদের ইউনিভার্সিটিতে এসে ইংরেজী বা ইকনমিক্স পড়া ছিল ফ্যাশন। আমিও ফ্যাশনমত ইকনমিক্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। এক বন্ধু পড়বে কেমিস্ট্রি। তাকে নিয়ে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে এসেছি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। কেমিস্ট্রির একজন স্যার হঠাৎ বারান্দায় এলেন। তাঁকে দেখে আমি মুগ্ধ। কি স্মার্ট, কি সুন্দর চেহারা! তিনি কি মনে করে যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করলাম ইকনমিক্স জলে ভেসে যাক। আমি পড়ব কেমিস্ট্রি। ভর্তি হয়ে গেলাম কেমিস্ট্রিতে। ঐ স্যারের নাম মাহবুবুল হক। কালিনারায়ণ স্কলার। ভৌত রসায়নের ওস্তাদ লোক। যিনি অংক করিয়ে করিয়ে পরবর্তী সময়ে আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন।
পিএইচ ডি করতে গেলাম ভৌত রসায়নে। কোর্স ওয়ার্ক সব শেষ করেছি। দুবছর কেটে গেছে। একদিন বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট টানছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, তিনশ দশ নম্বর রুমে বুড়ো এক ভদ্রলোক ক্লাস নিতে ঢুকলেন। রোগা লম্বা একজন মানুষ। গায়ে আলখাল্লার মত কোট। আমার কি যে খেয়াল হল কে জানে। আমিও সেই ক্লাসে ঢুকলাম। সমস্ত কোর্স শেষ করেছি, আর কোর্স নিতে হবে না। কাজেই এখন নিশ্চিন্ত মনে একটা ক্লাসে ঢোকা যায়।
বুড়ো ভদ্রলোকের নাম জেনো উইকস্। পলিমার রসায়ন বিভাগের প্রধান। আমি তাঁর লেকচার শুনে মুগ্ধ। যেমন পড়ানোর ভঙ্গি তেমনই বিষয়বস্তু। দৈত্যাকৃতি অণুর বিচিত্র জগৎ। ক্লাস শেষে আমি তাঁকে গিয়ে বললাম, আমি আপনার বিভাগে আসতে চাই।
ভৌত রসায়নের প্রফেসর সব শুনে খুব রাগ করলেন। আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন–তুমি যা করতে যাচ্ছ, খুব বড় ধরনের বোকারাও তা করে না। পি এইচ ডি-র কাজ তোমার অনেক দূর এগিয়েছে। কোর্স ওয়ার্ক শেষ করেছ এবং খুব ভালভাবে করেছ। এখন বিভাগ বদলাতে চাও কেন? মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে দাও।
আমি ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না। ঢুকে গেলাম পলিমার রসায়নে। প্রফেসর জেনো উইকস্ অনেক করলেন। আমাকে ভাল একটা স্কলারশীপ দিলেন। বইপত্র দিয়ে সাহায্য করলেন। কাজ শুরু করলাম পলিমার রসায়নের আর এক জাঁদরেল ব্যক্তি প্রফেসর গ্লাসের সঙ্গে। পলিমারের সব কোর্স যখন নিয়ে শেষ করেছি তখন প্রফেসর গ্লাস আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে বললেন, মাই ডিয়ার সান, দয়া করে এখন শখের বসে অন্য কোন ক্লাসে গিয়ে বসবে না। ডিগ্রী শেষ কর। আরেকটা কথা–আমেরিকান সিটিজেনশীপ পাওয়ার ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।
আমি বললাম, আমেরিকান সিটিজেনশীপ দিয়ে আমি কি করব?
তুমি চাও না?
না, আমি চাই না। ডিগ্রী হওয়ামাত্র আমি দেশে ফিরে যাব।
বিদেশী ছাত্ররা শুরুতে সবাই এ-রকম বলে। শেষে আর যেতে চায় না।
আমি চাই।
ডিগ্রী শেষ করে দেশে ফিরলাম। সাত বছর আমেরিকায় কাটিয়ে যে সম্পদ নিয়ে ফিরলাম তা হল নগদ পঞ্চাশ ডলার, দুই স্যুটকেস ভর্তি বাচ্চাদের পুরানো খেলনা, এক স্যুটকেস বই এবং প্রচুর চকলেট।
আমি যে সব সময় ইমপাএর উপর চলি তা কিন্তু না। কাজে-কর্মে, চিন্তা-ভাবনায় আমি শুধু যে গোছানো তা না, অসম্ভব গোছানো। কখন কি করব, কতক্ষণ করব তা আগে ভাগে ঠিক করা। কঠিন রুটিন। সময় ভাগ করা। তারপরেও হঠাৎ হঠাৎ কেন জানি মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। উদ্ভট এক একটা কাণ্ড করে বসি। কোন সুস্থ মাথার মানুষ যা কখনো করবে না।