সন্ধ্যা বেলা বর এল। বর এসেছে, বর এসেছে খুব হৈ চৈ হচ্ছে। মেয়েটির ঘুম ভেঙে গেল। সে একা একা উঠে গেল ছাদে। ছাদ থেকে ঝুঁকে সে বর দেখার চেষ্টা করছে–হঠাৎ পা পিছলে গেল। দুতলা থেকে পাকা বারান্দায় মেয়েটি পড়েছে, মাথা ফেটে গেছে, গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে, তার কালো চুল হয়ে গেল টকটকে লাল।
গল্পের শুরু এখান থেকে–মেয়েটির মৃত্যুর পর। কি অভিভূত যে হয়েছিলাম গল্প পড়ে! গল্প শেষ করবার পর মনে হচ্ছিল মেয়েটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর রেশমী শাড়ির খসখস শব্দ কানে আসছে, গা থেকে চাপা ফুলের ঘ্রাণ আসছে।
আমার জীবনের প্রথম লেখা গল্পটিও ছিল ভৌতিক গল্প। স্কুল ম্যাগাজিনের জন্যে লেখা ভয়ংকর ভৌতিক কাণ্ডকারখানা আছে। অবশ্যি শেষের দিকে দেখা গেল পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে স্বপ্নে।
সচেতনভাবে ভূতের গল্প লিখি ৮৭ সনের দিকে। নাম দেবী। দেবী লেখার ইতিহাসটাও বেশ মজার–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর জাফর মাহমুদের বাসায় এক সন্ধ্যায় গিয়েছি। স্যার বললেন, হুমায়ুন, আমার এক আত্মীয়া তোমাকে দেখতে চায়। ও বোধহয় কিছু বলবে। তোমার বই-টই পড়েছে।
আমি বললাম, নিয়ে আসুন স্যার।
স্যার ১৮/১৯ বছরের এক তরুণীকে নিয়ে ঢুকলেন। মেয়েটা রোগা।
অতিরিক্ত রকমের ফর্সা। তাকে রূপবতী বলা যায়, তবে চোখে এক ধরণে অস্বাভাবিকতা আছে। এই দৃষ্টি মানুষকে কাছে টানে না, দূরে সরিয়ে দেয়।
আমি হাসিমুখে বললাম, তুমি আমাকে কিছু বলবে?
সে কঠিন চোখে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে চলে গেল।
আমি অপ্রস্তুত। জাফর স্যারও অপ্রস্তুত। আমি বললাম, স্যার মেয়েটির বোধহয় লেখক পছন্দ হয় নি। সে হয়তো আরো ভারিক্তি কাউকে আশা করেছিল।
স্যার বললেন, ব্যাপার তা না। ওর কিছু সমস্যা আছে। পঁাড়াও, তোমাকে বলি–মেয়েটার বাড়ি পদ্মা নদীর তীরে। বাড়িতে টিউবওয়েল আছে, তবু বেশির ভাগ সময় নদীতেই এরা গোসল করে। মেয়েটির বয়স তখন বারো কিংবা তেরো। নদীতে গোসল করছে হঠাৎ তার কাছে মনে হল কে যেন তার দুপা জড়িয়ে ধরেছে। সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল। পা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল। পারল না। যতই ছাড়াতে চেষ্টা করে ততই জোরে দুটা মানুষের হাতের মত হাত তাকে চেপে ধরে। মেয়েটির চিৎকারে অনেকেই ছুটে এল। তাকে টেনে পারে তোলা হল। দেখা গেল একটি মৃতদেহ মেয়েটির পা জড়িয়ে ধরে আছে। মৃতদেহটির মাথা নেই। ভয়াবহ ঘটনা। মেয়েটির মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন তার চিকিৎসা চলে। ঢাকায় সে চিকিৎসার জন্যে এসেছে। এখন সে অনেক ভাল। আমরা মেয়েটির বিয়ে দেবার চেষ্টা করছি।
আমি গভীর আগ্রহে বললাম, স্যার, আমি মেয়েটাকে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই। আপনি কি তাকে একটু ডাকবেন?
স্যার উঠে গেলেন এবং ফিরে এসে বললেন, ও আসবে না। অনেক বুঝালাম।
দেবী উপন্যাসে আমি এই মেয়েটির গল্পই বলেছি।
ভূত-প্রেত বিষয়ক অনেক লেখা লিখলেও আমি কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন ভূত দেখি নি। আমার কোন রকম ভৌতিক অভিজ্ঞতাও নেই। বেশ কয়েকবার তীব্র ভয় পেয়েছি। এর বেশি কিছু না। ভয় পাওয়া এক ব্যাপার–ভূত দেখা অন্য ব্যাপার।
একটা ভয় পাওয়ার গল্প বলি–রাতে ঘুম আসছে না। আমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছি। শহীদুল্লাহ হলের যে বাসায় আমি থাকি তার বারান্দাটা দেখার। মত। তিনশ ফুটের মত লম্বা। আমি বারান্দার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাচ্ছি, আবার ফিরে আসছি। বারান্দার সব বাতি নেভানো। তবু বেশ আলো আছে। বাসার সবাই ঘুমে অচেতন। আমার মেজো মেয়ের ঘুমের মধ্যে খিলখিল করে হাসার রোগ আছে। একবার সে হেসে আবার চুপ করে গেল।
বারান্দায় বুক শেলফের কাছে একটা বেতের চেয়ার আছে। বেশ খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আমি ক্লান্ত হয়ে চেয়ারটায় বসলাম। বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আতংকে অস্থির হয়ে পড়লাম। এই আতংকের ধরন আলাদা। এর জন্ম আমাদের চেনা-জানা পৃথিবীতে নয়। অন্য কোথাও। আমার মনে হল আমার চেয়ারের ঠিক পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে যে তার বরফশীতল হাত এক্ষুনি আমার দুচোখের উপর রাখবে।
চিৎকার করে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার চিৎকার এতই ভয়াবহ ছিল যে আমার স্ত্রীর ঘুম ভাঙল। আমার কন্যাদের ঘুম ভাঙল।
এই ভয়াবহ ঘটনার আমি নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। ব্যাখ্যাটা বলি–অনিদ্রায় ক্লান্ত হয়ে আমি চেয়ারে বসামাত্র ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমুবার সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
এই ব্যাখ্যা যে কোন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার কথা, আমার কাছে নয়–কারণ অনিদ্রা রোগ আমার দীর্ঘদিনের সাথী। ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়ার মত অবস্থা কখনো আমার হয় না। সেদিনও হয় নি।
তাহলে এমন ভয়ংকর ভয় কেন পেলাম? এই ভয় কি আমার অবচেতন মনের কোন অন্ধ গুহায় লুকিয়ে ছিল? শুনেছি, কোন মানুষ পাগল হবার আগে অকারণেই প্রচণ্ড ভয় পায়। তীব্র ভয়ে অভিভূত হবার পরপরই পাগলামি শুরু হয়। সে চলে যায় ভয় এবং আনন্দের উর্ধ্বে।
আমি আমার পরিচিত মানুষদের প্রায়ই জিজ্ঞেস করি–আচ্ছা, আপনি কি কখনো অকারণে তীব্র ভয় পেয়েছেন? আমার এই সহজ প্রশ্ন কেউই বুঝতে পারেন না। সঙ্গে সঙ্গে বলেন–হা হা, পেয়েছি। অবশ্যই পেয়েছি–একদিন কি হয়েছে শুনুন। রিকশা করে যাচ্ছি হঠাৎ একটা প্রাইভেট কার এসে ধাক্কা দিয়ে রিকশাটা ফেলে দিল। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তার মাঝখানে–তাকিয়ে দেখি দানবের মত একটা ট্রাক ছুটে আসছে–ভয়ে আতংকে