আমি অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি খুব ছেলেবেলার কোন অদ্ভুত স্মৃতি তাদের আছে কি না। কেউ তেমন অদ্ভুত কিছু আমাকে বলে নি। আমার মেজো মেয়ে শীলার বয়স তিন। তাকে আমি বলেছি, মজার মজার কোন জিনিস যদি কখনো দেখ, আমাকে বলবে। সে এটাকে খেলা মনে করে রোজ আমাকে তিন চারটি গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলে। এগুলি বানানো গল্প। তা দুএকটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে।
বাবা, আজকে আমি দেখলাম, জানালা দিয়ে একটা কাক এসে তোমার সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে কপ করে খেয়ে ফেলেছে।
বাবা, আজ দেখলাম, একটা ছাগল মটর গাড়ি চালাচ্ছে।
আমার এক্সপেরিমেন্ট সফল হয় নি। শৈশবের স্মৃতির একটা বড় অংশ মিথ্যা স্মৃতি–এটা প্রমাণ করার মত যুক্তি আমার হাতে নেই। না-থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে, কেউ মনে করেন না তাঁদের স্মৃতির মধ্যে ভেজাল আছে। সারা জীবন সমস্ত স্মৃতিকে সত্যই ভাবেন। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কোন স্মৃতি যদি থাকে তবে তার তিনি একটি স্বাভাবিক ব্যাখ্যা দেন। সহজভাবেই বলেন–আরে দূর, ছোটবেলায় কি দেখতে কি দেখেছি। কিছু মনে আছে নাকি?
কিন্তু আমি কোন অস্পষ্ট স্মৃতির কথা বলছি না। আমি বলছি এমন সব স্মৃতির কথা যেগুলি স্বর্ণখণ্ডের মত চকচক ঝকঝক করছে। যেমন আমার দেখা আগুন লাগার দৃশ্যটির কথা। যার প্রতিটি ছবি এখনো পরিষ্কার দেখতে পাই, যে মেয়েটি আমাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আগুনের আঁচে কিংবা ঘটনার উত্তেজনায় তার কপালে যে ঘাম জমেছিল সেগুলি পর্যন্ত আমার চোখে ভাসে।
এটা স্বপ্নদৃশ্য নয়–স্বপ্ন হয় অস্পষ্ট। যেখানে কোন চিত্রই পরিষ্কার ভাবে আসে না। স্বপ্নে একটি ঘটনার সঙ্গে অন্য ঘটনার কোন মিল থাকে না। সমগ্র স্বপ্নে একটা ছাড়াছাড়া ভাব থাকে। আমার দেখা ঐ আগুন লাগার দৃশ্যে বা ঘোড়ার দৃশ্যে কোন অস্পষ্টতা নেই। ছাড়াছাড়া ভাব নেই।।
তুষারপাতের দৃশ্যটির কথা আমি না হয় বাদ দিচ্ছি। ধরে নিচ্ছি, ঐদিন এত বেশি বৃষ্টি হচ্ছিল কিংবা শিল পড়ছিল যাতে সব শাদা হয়ে গেছে। কিন্তু আগুন লাগার দৃশ্যটি বা ঘোড়ার দৃশ্যটির ব্যাখ্যা কি?
বড় রহস্যময় একটি জগতে আমরা বাস করি। আমাদের চারপাশে বিপুল অন্ধকার। বড় ইচ্ছা করে এই গাঢ় অন্ধকার অন্তত একবারের জন্য হলেও কাটুক। একবার অন্তত বিপুল রহস্যের একটা অংশকে স্পর্শ করি।
কোনদিন কি তা সম্ভব হবে?
আস্তিক না নাস্তিক
মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়–আপনি কি আস্তিক? আল্লাহ বিশ্বাস করেন? এই সব ক্ষেত্রে হ্যাঁ বলা বিপদ, আবার না বলাও বিপদ। প্রশ্নকর্তা যদি নাস্তিক হন–আমি হ্যাঁ বললে অসংখ্য যুক্তিতর্ক ফাঁদবেন এবং প্রমাণ করতে চেষ্টা করবেন যে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। একটাই আমাদের জীবন। এইসব যুক্তি সবই আগে শোনা। নতুন কথা কেউ বলতে পারেন না। পুরানো জিনিস বারবার শুনতে ভাল লাগার কথা না। আমার কখনো ভাল লাগে না। ভাল না লাগলেও এই প্রশ্ন আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়।
উত্তরে আমি সাধারণত বলি, আপনার কি মনে হয়? এই বলে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করি। আলোচনা নিয়ে আসতে চেষ্টা করি ভূত-প্রেতের দিকে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের চেয়ে ভূত-প্রেতের অস্তিত্বের আলোচনা সহজ।
তবে সমস্যা আছে। ভূত-প্রেত নিয়ে আলোচনা শুরু হলে অসংখ্য ভূতের গল্প শুনতে হয়। যিনি ভূতে বিশ্বাস করেন না তাঁর স্টকেও গোটা দশেক ভূতের গল্প জমা থাকে। তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করেন গল্প শোনাতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সব ভূতের গল্পের ফমূলা এক। অশরীরী আত্মা এসে কিছু বলবে। ঠিকমত বলতে না পারলে এই জাতীয় গল্পগুলি অত্যন্ত হাস্যকর শোনায়। অধিকাংশ সময়ই গল্পকথক তা জানেন না।
মূল ব্যাপার হচ্ছে পরিবেশ সৃষ্টি। পরিবেশ সৃষ্টি অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। হাসির গল্প বলার জন্যে পরিবেশ তৈরি করার কোন প্রয়োজন নেই–গল্পটা বলে ফেললেই হল। দুপুর রোদে হাটের মাঝখানে ভূতের গল্প বলা যায় না। বর্ষার রাত, হারিকেনের আলো, অসম্ভব মনোযোগী কিছু শ্রোতা ছাড়া ভূতের গল্প হয় না।
একবার আমার এক বন্ধুর সঙ্গে রিকশা করে নিউ মার্কেট যাচ্ছি। ভরদুপুর–ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ। বন্ধু হঠাৎ কি মনে করে ভূতের গল্প শুরু করলেন। তাঁর বাড়ির ঘটনা। আমার ইচ্ছা করছিল কোন একটা ট্রাক এলে ধাক্কা দিয়ে তাকে ট্রাকের নিচে ফেলে দিতে। এতটা নির্বোধ মানুষ কি করে হয়? সে গল্পটা বলছেও খুব হেলাফেলা ভাবে–তখন মনে হল, আরে, এই লোক তো আসলে ভূতের গল্প বলবে বলে বলছে না। আমাকে ভয় পাওয়ানো তার উদ্দেশ্য নয়। সে তার বাড়ির একটি ঘটনা বর্ণনা করছে। আমি আগ্রহ নিয়ে শুনতে লাগলাম–গল্প শেষ হলে আতংকে দম বন্ধ হয়ে যাবার মত অবস্থা হল। এখান থেকে
একটা জিনিস শিখলাম–ভূতের গল্পের জন্যে পরিবেশ কোন অত্যাবশ্যকীয়। ব্যাপার নয়। মূল বিষয় হচ্ছে, বিশ্বাসযোগ্যভাবে গল্পটি বলা। শ্রোতার মনে ধারণা তৈরি করে দেয়া যে গল্পটা সত্যি।
ভূতের গল্পের প্রতি আমার দুর্বলতা সীমাহীন। রহস্যময়তার জন্যেই এই গল্পগুলি আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। খুব ছোটবেলায় মনোজ বসুর একটা গল্প পড়েছিলাম–লাল চুল। একটি মেয়ের বিয়ে হবে। বর আসবে সন্ধ্যায়। যেহেতু তাকে রাত জাগতে হবে তাকে অবেলায় শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হল। যাতে সে নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারে সেজন্যে ঘর খালি। মেয়েটি একা একা ঘুমুচ্ছে।