মুশকিল হচ্ছে, এ রকম কোন ঘটনা কি আসলে ঘটেছিল? বাড়ির অন্য কেউ ঘটনাটা মনে করতে পারেন না। এত বড় একটা ব্যাপার কারো মনে থাকবে না? তাছাড়া ঘোড়া আমাদের দেশে এমন কোন সুলভ প্রাণী নয়। তাহলে আমার এই স্মৃতিটি কি মিথ্যা স্মৃতি?
অবশ্যি আমাদের একটা ঘোড়া ছিল। কয়েকদিনের জন্যে প্রকাণ্ড এই প্রাণীটিকে কেনা হয়েছিল। আমার বাবার অনেক ধরনের পাগলামির একটি। সেই ঘোড়ার রঙ লাল। কালো মোটেই নয়। তার চেয়েও বড় কথা–আমার এই স্মৃতি, ঘোড়া কেনারও আগের স্মৃতি।
তবু ধরে নিচ্ছি স্মৃতি প্রতারণা করছে, আগের ঘটনা পরে নিয়ে গেছে। যেহেতু খানিকটা হলেও সন্দেহ আছে। এই ঘটনা বাতিল করে দেয়া যাক।
আরেকটা ঘটনা বলি। নানার বাড়ি গিয়েছি বিয়ে উপলক্ষে। সব কটি শিশুকে একটা প্রকাণ্ড বিছানায় শোয়ানো হয়েছে। চার-পাঁচটি লেপ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে আমাদের। প্রচণ্ড শীত। ঘুম আসব আসব করছে–এমন সময় শোনা গেল–আগুন আগুন। পাশের কয়েকটা ঘর পরেই আগুন লেগেছে। চিৎকার ও ছুটাছুটি। উত্তেজনায় কিছুই খেয়াল নেই। হঠাৎ এক সময় লক্ষ্য করলাম অপরিচিত একটি মেয়ে আমাকে কোলে নিয়ে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির মুখ দেবী প্রতিমার মত। গা ভর্তি গয়না। সে আগুনের দিকে তাকিয়ে খুব হাসছে এবং যতবারই আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাই ততবারই সে বলে, দেখ দেখ! আগুন দেখ। এই বলে সে আমার মুখ আগুনের দিকে ফিরিয়ে দেয়। আগুনটা ছিল দেখবার মতই। কিছু সময় পর আগুন আশেপাশের বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লো। লাল হয়ে গেল চারদিক। দূর-দূর থেকে লোকজন ছুটে এলো। এত অল্প সময়ে এত দ্রুত ঘটনাগুলি ঘটলো যে আমার আর কিছুই খেয়াল নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরবর্তী সময়ে আমি দেখলাম আগুন লাগার ঘটনাটি কারোর মনে নেই। আমার বড় মামা বললেন–গ্রামের আগুন লাগা একটা ভয়াবহ ব্যাপার। সবারই মনে থাকতো। এ জাতীয় কোন ঘটনা ঘটে নি। তুমি স্বপ্নে-টপ্নে দেখেছ। তাছাড়া গ্রাম ঘরে এত গয়না পরে কোন মেয়ে থাকে না। খুবই যুক্তিসংগত কথা। তাহলে আমাকে কোলে নিয়ে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল এবং বারবার আমাকে আগুন দেখাচ্ছিল সে কে? অথচ সেই রূপবতী মেয়ের লম্বাটে মুখ পর্যন্ত আমার মনে আছে। ছবি আঁকতে জানলে ছবি আঁকতাম।
শৈশবের স্মৃতির মধ্যে কি তাহলে কোন রহস্য আছে। যে সব ঘটনা স্মৃতি বলে ভেবে রাখি তার সবগুলি এ-জীবনে আদৌ ঘটে নি। তা কেমন করে হয়? শৈশবের স্মৃতি কি তাহলে দুরকমের? সত্যি স্মৃতি ও মিথ্যা স্মৃতি?
এই নিয়ে আমি প্রথম গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করি যখন আমার বয়স তেত্রিশ। সন-তারিখ মনে নেই, আমি তখন আমেরিকাতে। ল্যাবরেটরিতে কাজ করছি, টমাস বাইহোফার নামের একজন গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট এসে বললো–যাও বাইরে গিয়ে দেখো, তুষার ঝড় শুরু হয়েছে। বাইরে বেরিয়ে দেখি চারদিক বরফে ঢেকে গেছে। শো শো শব্দ হচ্ছে। তুষার পড়ছে সমানে। দুহাত দূরের মানুষটিকে পর্যন্ত দেখা যায় না। এই প্রথম তুষারপাত দেখা। অদ্ভুত অনুভূতি। কিন্তু আমার চট করে মনে হলো অবিকল এই দৃশ্য আমি দেখেছি সিলেটের মীরা বাজারে। একদিন দুপুরবেলা আকাশে খুব মেঘ করেছে। আমরা যাতে বাইরে যেতে না পারি সে জন্যে দরজার হুড়কো লাগিয়ে মা পাটি বিছিয়ে ঘুমাচ্ছেন। এমন সময় বৃষ্টি শুরু হলো। আমি বৃষ্টি দেখবার জন্যে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি চারদিক শাদা হয়ে গেছে। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না! সেই শৈশবেই বুঝতে পারলাম এটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ____। কিন্তু আমার কাউকে ডাকতে ইচ্ছা হলো না। আমি একাই অবাক হয়ে সেই দৃশ্য দেখলাম।
এর মানে তাহলে কি দাঁড়ায় বা আদৌ কোন মানে দাঁড় করানো যায় কি? এগুলি কি শৈশবের ফ্যান্টাসি? শিশু বয়সে কল্পনায় এ-রকম একটি দৃশ্য তৈরি করেছি যা মিলে গেছে বাস্তবের সঙ্গে বা কাছাকাছি একটা মিল পাওয়া গেছে?
আছাদ নামের আমাদের একজন কাজের লোক ছিল। সে সব সময় বলত খুব ছোট বয়সে সে একবার পরী দেখে। পরীর বর্ণনাটা বইয়ের পরীর আঁকা ছবির সঙ্গে মিলে না। পরীটার গায়ে নাকি কচি ঘাসের মত একটা বাজে গন্ধ ছিল। পায়ের নখগুলি ছিল পাখির নখের মত অস্বাভাবিক লম্বা এবং গায়ের রং ধবধবে শাদা নয়–ছাই বর্ণের। অসংখ্যবার সে এই পরীর গল্প আমাদের করেছে। তখন আমি বেশ বড় এবং বুঝতে শিখেছি যে রূপকথার পরীকে বাস্তবে দেখার কোনই সম্ভাবনা নেই। কাজেই আছাদ যতবারই এ-গল্প বলে ততবারই আমি তাকে ঠাট্টা করি এবং সে কেঁদেকেটে এক কাণ্ড করে। যেন এ-গল্প বিশ্বাস করতেই হবে।
বছর সাতেক আগে আমাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। এখন রীতিমত একজন বুড়ো মানুষ। আমি সেই পরীটির কথা জিজ্ঞেস করতেই সে ঠিক আগের মত উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করলো। ঘাসের গন্ধের কথা বললো কিন্তু পরীটিকে কোথায় দেখেছে, দিনে দেখেছে না রাতে দেখেছে সে সব কিছুই বলতে পারলো না। তার নাকি মনে নেই। শুধু মনে আছে পাখির নখের মত লম্বা নখ। ছাই বর্ণের গা।
আমি খুব অস্বস্তি নিয়ে বললাম, গায়ে কাপড় ছিল না নগ্ন ছিল? আছাদ জবাব দিল না মাথা নিচু করে রইল। জবাবটা এই থেকে আঁচ করা যায়।