অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের–পরম পুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ আমার প্রিয় গ্রন্থের একটি। রামকৃষ্ণের মজার উক্তি, তাঁর হিউমার এবং জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করার অসাধারণ ক্ষমতা সব সময়ই আমাকে মুগ্ধ করেছে।
রামকৃষ্ণের আলোচনা যখন উঠল লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি কয়েকটা গল্প বললাম।
.
রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, ঈশ্বর কি?
রামকৃষ্ণ বললেন, বলছি। তার আগে তুই বল, ঘি কি?
ভক্ত বিস্মিত হয়ে বলল, ঘি হচ্ছে ঘি।
রামকৃষ্ণ বললেন, ঈশ্বর হচ্ছে ঈশ্বর।
.
সাধক ভক্ত রামকৃষ্ণকে বললেন, আমি কুড়ি বছর সাধনা করে মহাবিদ্যা আয়ত্ত করেছি।
কি সেই মহাবিদ্যা?
আমি এখন পায়ে হেঁটে নদী পার হতে পারি।
আরে গাধা, একটা পয়সা দিলেই তো খেয়া নৌকার মাঝি তোকে নদী পার করে দেয়। তোর এই সাধনার মূল্য হল এক পয়সা। আসল সাধনা শুরু কর।
.
রামকৃষ্ণ বলছেন–যত মত তত পথ। নদী নানা দিক দিয়ে আসে, কিন্তু পড়ে গিয়ে সেই সমুদ্রে। তেমনি ছাদে নানা উপায়ে উঠা যায়। পাকা সিঁড়ি, কাঠের সিঁড়ি, বাঁকা সিঁড়ি, ঘোরানো সিঁড়ি। ইচ্ছে করলে শুধু একটা দড়ি দিয়েও উঠতে পারো। তবে যেভাবেই ওঠো একটা কিছু ধরে উঠতে হবে। সেই একটা কিছু হচ্ছে ধর্ম। যা তুমি ধরবে, তা বাপু একটু শক্ত করে ধরো। পা পিছলে পড়ে না যাও।
এই আশ্রমের একটা জিনিস আমার পছন্দ হল না–মেয়েদের এখানে স্থান নেই। মেয়েরা সাধনার বাধা। এদের সরিয়ে রাখতে হবে দূরে।
আমি সাধুজীকে বললাম, এ-রকম হল কেন? রামকষ্ণ নিজে তো বিবাহিত ছিলেন।
তিনি বললেন, আশ্রমের নিয়ম-কানুন স্বামী বিবেকানন্দের করা। তিনি ছিলেন চিরকুমার।
আপনি নিজে কি মনে করেন মেয়েরা সাধনার বাধা?
তিনি জবাব দিলেন না।
আমি বললাম, শেষ প্রশ্ন–আপনার কি এই দীর্ঘ সন্ন্যাস জীবনে একবারও মন কেমন করে নি? একবারও ইচ্ছে হয় নি গৃহবাসী হতে?
সাধুজী এই প্রশ্নের জবাবে বললেন, আপনারা কিন্তু আবার আসবেন। চারটা ডাল ভাত আমার সঙ্গে খাবেন। আশ্রমে অতিথিশালা আছে। এর পরের বার এলে উঠতে হবে আমার অতিথিশালায়। মূল প্রশ্ন আবারো এড়িয়ে গেলেন।
আশ্রমের ছেলেরা দল বেঁধে অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দ এবং বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম তাদের অনেকের কাছেই আমার মত গৃহী মানুষের লেখা বই।।
ডাকবাংলোয় ফিরে এলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে একটা বেজে গেল। আমি নওয়াজীশ ভাইকে বললাম, আজ একটু নিয়মের ব্যতিক্রম করলে কেমন হয়?
কি রকম?
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। চলুন, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাই। একটা নৌকা ভাড়া করে ব্রহ্মপুত্র নদীতে ঘুরে বেড়াই।
আমি ভেবেছিলাম তিনি রেগে যাবেন, রাগলেন না। আমাকে অবাক করে দিয়ে সহজ গলায় বললেন–চলুন।
মোজাম্মেল হোসেন শুয়ে পড়েছিলেন। তিনি গলা পর্যন্ত চাদর টেনে দিয়ে বললেন, খবর্দার আমাকে ডাকবেন না। আমি এইসব পাগলামিতে নেই। এটা একটা কথা হল রাত একটায় ব্রহ্মপুত্র?
আমি নওয়াজীশ ভাইকে নিয়ে গেট পর্যন্ত চলে গিয়েছি। দেখি ভিজতে ভিজতে মোজাম্মেল সাহেব আসছেন। তিক্ত গলায় বলছেন–কোন মানে হয়? এই পাগলামির কোন মানে হয়?
সারারাত আমরা নৌকায় কাটালাম। খোলা নৌকায় চিৎ হয়ে শুয়ে বৃষ্টিতে ভিজলাম। মোজাম্মেল সাহেব একটু পরপর বলতে লাগলেন–অপূর্ব!!
ভোরবেলা মেঘ কেটে আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করল। আমি নওয়াজীশ ভাইকে বললাম, সন্ন্যাসী হয়ে গেলে কেমন হয়?
নওয়াজীশ ভাই বললেন, আমি রাজি। চলুন নৌকা ভাসিয়ে দেই।
আমরা নৌকা ভাসালাম না। তবে সবাই শার্ট খুলে নদীর পানিতে ফেলে দিলাম। নৌকার মাঝি অবাক হয়ে বলল, কি হইছে?–আপনারার কি হইছে?
সে বৈঠা দিয়ে তিনটা শার্টের মধ্যে দুটা শার্ট উদ্ধার করল।
ভোরবেলা ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর নির্মিত চীন মৈত্রী সেতু দিয়ে হেঁটে হেঁটে তিনজন ফিরছি। কারো গায়ে শার্ট নেই। আমাদের ঘোর কেটে গেছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি। এখন আমাদের চেষ্টা কত দ্রুত আস্তানায় ফিরে ভদ্র হওয়া যায়।
মর্নিং ওয়াক করতে বের হওয়া এক ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। একি সমস্যায় পড়া গেল! আমি অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁটছি। ভদ্রলোক আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, আপনি কি হুমায়ূন আহমেদ?
আমি মধুর হেসে বললাম, আপনি ভুল করছেন। আমি অন্য ব্যক্তি।
খুব ছোটবেলার কথা
খুব ছোটবেলার কথা মনে করতে গেলেই দেখি দুএকটা বিচ্ছিন্ন চিত্র ছাড়া আর কিছু মনে নেই। এটা বোধহয় সবার জন্যেই সত্যি। সুদূর শৈশবে কিছু গুরুত্বহীন ঘটনা কোন বিশেষ কারণে কাউকে অভিভূত করে। সেটি মনে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। সেগুলিই মনে থাকে, অন্য কিছু আর মনে থাকে না।
কিন্তু তার মধ্যেও রহস্য আছে। সেই রহস্য বিষয়ে বলবার আগে আমার খুব ছোটবেলার একটা স্মৃতি সম্পর্কে বলি। চোখ বুজলেই আমি ছেলেবেলার এই ছবিটি দেখি–একটা ফাঁকা জায়গায় প্রকাণ্ড একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়াটি ঘন কৃষ্ণবর্ণ। আমার মামা আমাকে সেই ঘোড়ার পিঠে চড়াবার চেষ্টা করছেন। আমি ভয়ে মামার গলা ঝাপ্টে ধরে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছি। হঠাৎ ঘোড়াটি বিরক্ত হয়ে প্রবল একটা গা-ঝাঁকুনি দিল। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম অনেকখানি দূরে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। পরিষ্কার ছবি।