তিনি মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, রাত তিনটার সময় কে আপনাকে চা বানিয়ে দেবে? সব সময় রসিকতা ভাল লাগে না।
আসুন, খুঁজে দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা। গরমও পড়েছে। খোলা হাওয়ায় হাঁটাহাঁটি করলে ভাল লাগবে।
উনি বের হলেন। মোজাম্মেল সাহেবও এলেন। আমরা চায়ের সন্ধানে যাচ্ছি। শুনে আবুল খায়েরও লাফিয়ে উঠলেন। যে কোন ধরনের অ্যাডভেনচারে এই মানুষটির প্রবল উৎসাহ।
আমি তাঁদের দোকানের সামনে নিয়ে গেলাম। দোকান বন্ধ। ঝাপ ফেলা। আমি তিনবার ডাকলাম–মেকু, মেকু, মেকু।।
ঝাঁপ খুলে মেকু এবং মেকু-কন্যা বের হয়ে এল। কেউ কোন কথা বলল না। সবার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে প্রবল উৎসাহে চুলা ধরাতে শুরু করল। নওয়াজীশ ভাই বললেন, ব্যাপারটা কি বলুন তো?
আমি উদাস গলায় বললাম, ব্যাপার কিছু না। ঐ লোকটার নাম মেকু। আমি মেকুর সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় চলে এসেছি। যখনি চা খেতে ইচ্ছা হবে, এই দোকানের সামনে এসে তিনবার মেকু বললেই চা চলে আসবে।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম ঘটনাটায় সবাই মজা পাবেন। দেখা গেল, যতটা মজা পাবেন বলে আমি ভেবেছিলাম তাঁরা তার চেয়েও দশ গুণ বেশি মজা। পেলেন। ডাকবাংলোয় ফিরে শুধু মেকুর গল্প।
মোজাম্মেল সাহেব গল্প বলার ব্যাপারে খুব পারদর্শী। তিনি চোখ বড় বড় করে হাত নেড়ে বলছেন,
অদ্ভুত কাণ্ড। জনমানব নেই। নিশুতি রাত। একটা বন্ধ ঘরের সামনে হুমায়ূন ভাই গিয়ে দাঁড়ালেন। গম্ভীর গলায় তিনবার বললেন–মেকু মেকু মেকু–ওমি চিচিং ফাঁক–দোকানের ঝাপ খুলে গেল।
মেকু রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। পরদিন ভোরেই আসাদুজ্জামান নূর গেলেন মেকুকে দেখতে। এক কাপ চা খেয়ে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলেন। মেকু লজ্জিত গলায় বলল, অত বড় নোটের ভাঙতি নাই।।
নূর বললেন, ভাঙতি দিতে হবে না। এটা আপনি রেখে দিন। আমি হচ্ছি জমিদার মানুষ–ছোট মির্জা। আপনি বোধহয় আমাকে চেনেন না।
জ্বে-না।
টেলিভিশন দেখলে বুঝতেন যে পঞ্চাশ টাকা ছোট মির্জার হাতের ময়লা। টেলিভিশনে কখনো দেখেন নি?
জে-না।
পরদিন রাতের কথা। আমাদের মেকাপম্যান উত্তম খুব বেজার মুখে আমাকে এসে বলল, স্যার আপনের কথা তো ঠিক না।
কোন্ কথাটা ঠিক না?।
আমি ঐ দোকানের কাছে গিয়ে অনেকবার মেকু বলে ডাকছিলাম। কেউ ঝাঁপ খুলল না।
চলুন তো ভাই যাই–দেখি কি ব্যাপার।
আবার আমার সঙ্গে একটা দল জুটে গেল। আমি তিনবার মেকু বলতেই ঝাঁপ খুলে গেল। পিতা-কন্যা ঝাপিয়ে পড়ল চুলা ঠিক করতে। বোঝা গেল–মেকু অন্য কারো ডাকে ঘরের ঝপ খুলবে না। ডাকতে হবে আমাকে। এই বিশেষ ব্যবস্থাটা শুধুমাত্র আমার জন্যই। অন্য কারো জন্যে নয়।
কদিন মেকু খুব জমজমাট ব্যবসা করল। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সবাই চা খেয়ে আসছে। নওয়াজীশ আলি খান মেকুকে একটা লুঙ্গি কিনে দিলেন।
আমাদের যাত্রার সময় হয়ে এল। শেষ চা খেতে গিয়েছি। প্রথমবারের মত এবারো একা একা গেলাম।
মেকু বলল, শুনলাম আইজ রাইত যাইতেছেন গিয়া।
আমি বললাম, হ্যাঁ।
আপনে যদি মনে কিছু না নেন, আমি আফনেরে এক কাপ চা খাওয়াইতে চাই। এটু ইজ্জত করতে চাই।
মনে কিছু করব না। ইজ্জত করুন।
মেকু চা বানাল। গ্লুকোজ বিসকিটের একটা প্যাকেট ছেঁড়া হল। সম্ভবত ইজ্জত করার উদ্দেশ্যেই প্যাকেটটা কেনা হয়েছে। আমি চা খেলাম, বিসকিট খেলাম।
চলে আসবার সময় লক্ষ্য করলাম মেকু বিষণ্ণ মুখে চুপচাপ বসে আছে। বাচ্চা মেয়েটি হঠাৎ উঠে এসে পা ছুঁয়ে আমাকে সালাম করে চোখ মুছতে লাগল। এই মেয়েটির সঙ্গে আমার একবারই কথা হয়েছে। আর কখনো কোন কথা হয় নি। আমি বলেছিলাম, বসো আমার পাশে, এসো একসঙ্গে চা খাই। অথচ আজ তার চোখে পানি এসে গেল। কি এমন করেছি আমি? আমি তো মেয়েটার নামও জানি না। একবার ইচ্ছা হল ফিরে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করি। পরমুহূর্তেই মনে হল–কি দরকার?
সংসারত্যাগী মানুষ
সংসারত্যাগী মানুষদের প্রতি আমি এক ধরনের মুগ্ধতা বোধ করি। এই মুগ্ধতার কারণ সম্ভবত জীবনানন্দ দাসের কবিতা–
অর্থ নয় কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
কোন্ বিপন্ন বিস্ময়ের কারণে এই সব মানুষ সংসার ত্যাগ করে তা জানতে ইচ্ছে করে। অবশ্যি এক অর্থে এরা আবার পলাতক মানুষ। সংসার থেকে পলাতক, জীবন থেকে পলাতক। দায়িত্ব থেকেও পলাতক। পলাতক মানেই পরাজিত। পরাজিত মানুষদের প্রতি মমতা কেন থাকবে?
ভবঘুরে মানুষকে এই সমাজ ভাল চোখে দেখে না। গালাগালি অর্থে আমরা ভবঘুরে শব্দটা ব্যবহার করি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সমস্ত ধর্ম প্রচারকরাই ভবঘুরে। জৈনধর্মের প্রচারক মহাবীর, শিখগুরু নানক, গৌতম বুদ্ধ–এঁরা কি জন্ম-ভবঘুরে নন?
মহাবীর শুধু যে ভবঘুরে তাই না, সর্বত্যাগী ভবঘুরে। তিনি সমাজ-সংসার সব তো ছেড়েছিলেনই–পরিধেয় বস্ত্রও ছেড়েছিলেন। উলংগ হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
ভবঘুরেদের প্রতিও আমার এক ধরনের মমতা আছে। প্রায়ই মনে হয়, কি সুন্দর তাদের জীবন! পাখির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভবঘুরে বীজ সম্ভবত আমাদের সবার রক্তেই খানিকটা আছে। ঘোর সংসার-আসক্ত মানুষও কোন এক বিষণ্ণ। সন্ধ্যায় ক্ষণিকের জন্যে হলেও ভাবে–সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে কোথাও চলে গেলে কেমন হয়? ঐ যে অন্তর্গত রক্তে বিপন্ন বিস্ময়।