এখন কথাটা দাঁড়িয়েছে, ‘খাজনা দেব কিসে’।
এতকাল উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিম থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নানা জাতের বুলবুলি এসে বেবাক ধান খেয়ে গেল, কারো হু ছিল না। জগতে যারা হুশয়ার এরা তাদের কাছে ঘেঁষতে চায় না, পাছে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। কিন্তু তারা অকস্মাৎ এদের অত্যন্ত কাছে ঘেঁষে, এবং প্রায়শ্চিতও করে না। শিরোমণি-চূড়ামণির দল পুঁথি খুলে বলেন, ‘বেহু যারা তারাই পবিত্র, হুশয়ার যারা তারাই অশুচি, অতএব হুশয়ারদের প্রতি উদাসীন থেকো, প্রবুদ্ধমিব সুপ্তঃ।’
শুনে সকলের অত্যন্ত আনন্দ হয়।
৫
কিন্তু, তৎসত্ত্বেও এ প্রশ্নকে ঠেকানো যায় না, ‘খাজনা দেব কিসে’।
শ্মশান থেকে মশান থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় হাহা ক’রে তার উত্তর আসে, ‘আব্রু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।’
প্রশ্নমাত্রেরই দোষ এই যে, যখন আসে একা আসে না। তাই আরও একটা প্রশ্ন উঠে পড়েছে, ‘ভূতের শাসনটাই কি অনন্তকাল চলবে।’
শুনে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি আর মাসতুতো-পিসতুতোর দল কানে হাত দিয়ে বলে, ‘কী সর্বনাশ। এমন প্রশ্ন তো বাপের জন্মে শুনি নি। তা হলে সনাতন ঘুমের কী হবে— সেই আদিমতম, সকল জাগরণের চেয়ে প্রাচীনতম ঘুমের?’
প্রশ্নকারী বলে, ‘সে তো বুঝলুম, কিন্তু আধুনিকতম বুলবুলির ঝাঁক আর উপস্থিততম বর্গির দল, এদের কী করা যায়।’
মাসিপিসি বলে, ‘বুলবুলির ঝাঁককে কৃষ্ঞনাম শোনাব, আর বর্গির দলকেও।’
অর্বাচীনেরা উদ্ধত হয়ে বলে ওঠে, ‘যেমন করে পারি ভূত ছাড়াব।’
ভূতের নায়েব চোখ পাকিয়ে বলে, ‘চুপ। এখনো ঘানি অচল হয় নি।’
শুনে দেশের খোকা নিস্তব্ধ হয়, তার পরে পাশ ফিরে শোয়।
৬
মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, বুড়ো কর্তা বেঁচেও নেই, মরেও নেই, ভূত হয়ে আছে। দেশটাকে সে নাড়েও না, অথচ ছাড়েও না।
দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ, যারা দিনের বেলা নায়েবের ভয়ে কথা কয় না, তারা গভীর রাত্রে হাত জোড় করে বলে, ‘কর্তা, এখনো কি ছাড়বার সময় হয় নি।’
কর্তা বলেন, ‘ওরে অবোধ, আমার ধরাও নেই, ছাড়াও নেই, তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া।’
তারা বলে, ‘ভয় করে যে, কর্তা।’
কর্তা বলেন, ‘সেইখানেই তো ভূত।’
শ্রাবণ ১৩২৬
কৃতঘ্ন শোক
ভোরবেলায় সে বিদায় নিলে।
আমার মন আমাকে বোঝাতে বসল, “সবই মায়া।”
আমি রাগ করে বললেম, “এই তো টেবিলে সেলাইয়ের বাক্স, ছাতে ফুলগাছের টব, খাটের উপর নাম-লেখা হাতপাখাখানি— সবই তো সত্য।”
মন বললে, “তবু ভেবো দেখো—”
আমি বললেম, “থামো তুমি। ঐ দেখো-না গল্পের বইখানি,মাঝের পাতায় একটি চুলের কাঁটা, সবটা পড়া শেষ হয় নি; এও যদি মায়া হয়, সে এর চেয়েও বেশি মায়া হল কেন।”
মন চুপ করলে। বন্ধু এসে বললেন, “যা ভালো তা সত্য, তা কখনো যায় না; সমস্ত জগৎ তাকে রত্নের মতো বুকের হারে গেঁথে রাখে।”
আমি রাগ করে বললেম, “কী করে জানলে। দেহ কি ভালো নয়। সে দেহ গেল কোন্খানে।”
ছোটো ছেলে যেমন রাগ করে মাকে মারে তেমনি করেই বিশ্বে আমার যা-কিছু আশ্রয় সমস্তকেই মারতে লাগলেম। বললেম, “সংসার বিশ্বাসঘাতক।”
হঠাৎ চমকে উঠলেম। মনে হল কে বললে, “অকৃতজ্ঞ! ”
জানলার বাইরে দেখি ঝাউগাছের আড়ালে তৃতীয়ার চাঁদ উঠছে, যে গেছে যেন তারই হাসির লুকোচুরি। তারা-ছিটিয়ে-দেওয়া অন্ধকারের ভিতর থেকে একটি ভর্ৎসনা এল, “ধরা দিয়েছিলেম সেটাই কি ফাঁকি, আর আড়াল পড়েছে, এইটেকেই এত জোরে বিশ্বাস? ”
গলি
আমাদের এই শানবাঁধানো গলি, বারে বারে ডাইনে বাঁয়ে এঁকে বেঁকে একদিন কী যেন খুঁজতে বেরিয়েছিল। কিন্তু, সে যে দিকেই যায় ঠেকে যায়। এ দিকে বাড়ি, ও দিকে বাড়ি, সামনে বাড়ি।
উপরের দিকে যেটুকু নজর চলে তাতে সে একখানি আকাশের রেখা দেখতে পায়— ঠিক তার নিজেরই মতো সরু, তার নিজেরই মতো বাঁকা।
সেই ছাঁটা আকাশটাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বলো তো দিদি, তুমি কোন্ নীল শহরের গলি।’
দুপুরবেলায় কেবল একটুখনের জন্যে সে সূর্যকে দেখে আর মনে মনে বলে, ‘কিচ্ছুই বোঝা গেল না।’
বর্ষামেঘের ছায়া দুইসার বাড়ির মধ্যে ঘন হয়ে ওঠে, কে যেন গলির খাতা থেকে তার আলোটাকে পেন্সিলের আঁচড় দিয়ে কেটে দিয়েছে। বৃষ্টির ধারা শানের উপর দিয়ে গড়িয়ে চলে, বর্ষা ডমরু বাজিয়ে যেন সাপ খেলাতে থাকে। পিছল হয়, পথিকদের ছাতায় ছাতায় বেধে যায়, ছাদের উপর থেকে ছাতার উপরে হঠাৎ নালার জল লাফিয়ে প’ড়ে চমকিয়ে দিতে থাকে।
গলিটা অভিভূত হয়ে বলে, ‘ছিল খট্খটে শুকনো, কোনো বালাই ছিল না। কিন্তু, কেন অকারণে এই ধারাবাহী উৎপাত?’
ফাল্গুনে দক্ষিণের হাওয়াকে গলির মধ্যে লক্ষ্ণীছাড়ার মতো দেখতে হয়; ধুলো আর ছেঁড়া কাগজগুলো এলোমেলো উড়তে থাকে। গলি হতবুদ্ধি হয়ে বলে, ‘এ কোন্ পাগলা দেবতার মাৎলামি!’
তার ধারে ধারে প্রতিদিন যে-সব আবর্জনা এসে জমে— মাছের আঁশ, চুলোর ছাই, তরকারির খোসা, মরা ইঁদুর, সে জানে এই-সব হচ্ছে বাস্তব। কোনোদিন ভুলেও ভাবে না, ‘এ সমস্ত কেন।’
অথচ, শরতের রোদ্দুর যখন উপরের বারান্দায় আড় হয়ে পড়ে, যখন পুজোর নহবত ভৈরবীতে বাজে, তখন ক্ষণকালের জন্যে তার মনে হয়, ‘এই শানবাঁধা লাইনের বাইরে মস্ত একটা-কিছু আছে বা!’
এ দিকে বেলা বেড়ে যায়; ব্যস্ত গৃহিণীর আঁচলটার মতো বাড়িগুলোর কাঁধের উপর থেকে রোদ্দুরখানা গলির ধারে খসে পড়ে; ঘড়িতে ন’টা বাজে; ঝি কোমরে ঝুড়ি করে বাজার নিয়ে আসে; রান্নার গন্ধে আর ধোঁয়ায় গলি ভরে যায়; যারা আপিসে যায় তারা ব্যস্ত হতে থাকে।