এই বলে সে কত কী বলে যেত; তার নিজের সঙ্গে নিজের কথা, সে কথার মানে বুঝবে কে।
কাঠকুড়নি বুঝত না, কিন্তু আকাশে নবমেঘের ডাকে ময়ূরীর যেমন হয় তেমনি তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠত।
তার পরে আরও কিছু দিন যায়। তপস্বী মৌন হয়ে এল, মেয়েকে কোনো কথা বলে না।
তার পরে আরও কিছু দিন যায়। তপস্বীর চোখ বুজে এল, মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখে না।
মেয়ের মনে হল, সে আর ঐ তাপসের মাঝখানে যেন তপস্যার লক্ষ যোজন ক্রোশের দূরত্ব। হাজার হাজার বছরেও এতটা বিচ্ছেদ পার হয়ে একটুখানি কাছে আসবার আশা নেই।
তা নাই-বা রইল আশা। তবু ওর কান্না আসে; মনে মনে বলে, দিনে একবার যদি বলেন ‘কেমন আছ’ তা হলে সেই কথাটুকুতে দিন কেটে যায়, এক বেলা যদি একটু ফল আর জল গ্রহণ করেন তা হলে অন্নজল ওর নিজের মুখে রোচে।
৩
এ দিকে ইন্দ্রলোকে খবর পৌঁছল, মানুষ মর্ত্যকে লঙ্ঘন করে স্বর্গ পেতে চায়— এত বড়ো স্পর্ধা।
ইন্দ্র প্রকাশ্যে রাগ দেখালেন, গোপনে ভয় পেলেন। বললেন, ‘দৈত্য স্বর্গ জয় করতে চেয়েছিল বাহুবলে, তার সঙ্গে লড়াই চলেছিল; মানুষ স্বর্গ নিতে চায় দুঃখের বলে, তার কাছে কি হার মানতে হবে।’
মেনকাকে মহেন্দ্র বললেন, ‘যাও, তপস্যা ভঙ্গ করো গে।’
মেনকা বললেন, ‘সুররাজ, স্বর্গের অস্ত্রে মর্তের মানুষকে যদি পরাস্ত করেন তবে তাতে স্বর্গের পরাভব। মানবের মরণবাণ কি মানবীর হাতে নেই।’
ইন্দ্র বললেন, ‘সে কথা সত্য।’
৪
ফাল্গুনমাসে দক্ষিণহাওয়ার দোলা লাগতেই মর্মরিত মাধবীলতা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। তেমনি ঐ কাঠকুড়নির উপরে একদিন নন্দনবনের হাওয়া এসে লাগল, আর তার দেহমন একটা কোন্ উৎসুক মাধুর্যের উন্মেষে উন্মেষে ব্যথিত হয়ে উঠল। তার মনের ভাবনাগুলি চাকছাড়া মৌমাছির মতো উড়তে লাগল, কোথা তারা মধুগন্ধ পেয়েছে।
ঠিক সেই সময়ে সাধনার একটা পালা শেষ হল। এইবার তাকে যেতে হবে নির্জন গিরিগুহায়। তাই সে চোখ মেলল।
সামনে দেখে সেই কাঠকুড়নি মেয়েটি খোঁপায় পরেছে একটি অশোকের মঞ্জরী, আর তার গায়ের কাপড়খানি কুসুম্ভফুলে রঙ করা। যেন তাকে চেনা যায় অথচ চেনা যায় না। যেন সে এমন একটি জানা সুর যার পদগুলি মনে পড়ছে না। যেন সে এমন একটি ছবি যা কেবল রেখায় টানা ছিল, চিত্রকর কোন্ খেয়ালে কখন এক সময়ে তাতে রঙ লাগিয়েছে।
তাপস আসন ছেড়ে উঠল। বললে, ‘আমি দূর দেশে যাব।’
কাঠকুড়নি জিজ্ঞাসা করলে, ‘কেন, প্রভু।’
তপস্বী বললে, ‘তপস্যা সম্পূর্ণ করবার জন্যে।’
কাঠকুড়নি হাত জোড় করে বললে, ‘দর্শনের পুণ্য হতে আমাকে কেন বঞ্চিত করবে।’
তপস্বী আবার আসনে বসল, অনেক ক্ষণ ভাবল, আর কিছু বলল না।
৫
তার অনুরোধ যেমনি রাখা হল অমনি মেয়েটির বুকের এক ধার থেকে আর এক ধারে বারে বারে যেন বজ্রসূচি বিঁধতে লাগল।
সে ভাবলে, ‘আমি অতি সামান্য, তবু আমার কথায় কেন বাধা ঘটবে।’
সেই রাতে পাতার বিছানায় একলা জেগে ব’সে তার নিজেকে নিজের ভয় করতে লাগল।
তার পরদিন সকালে সে ফল এনে দাঁড়াল, তাপস হাত পেতে নিলে। পাতার পাত্রে জল এনে দিতেই তাপস জল পান করলে। সুখে তার মন ভরে উঠল।
কিন্তু তার পরেই নদীর ধারে শিরীষগাছের ছায়ায় তার চোখের জল আর থামতে চায় না। কী ভাবলে কী জানি।
পরদিন সকালে কাঠকুড়নি তাপসকে প্রণাম করে বললে, ‘প্রভু, আশীর্বাদ চাই।’
তপস্বী জিজ্ঞাসা করলে, ‘কেন।’
মেয়েটি বললে, ‘আমি বহুদূর দেশে যাব।’
তপস্বী বললে, ‘যাও, তোমার সাধনা সিদ্ধ হোক।’
৬
একদিন তপস্যা পূর্ণ হল।
ইন্দ্র এসে বললেন, ‘স্বর্গের অধিকার তুমি লাভ করেছে।’
তপস্বী বললে, ‘তা হলে আর স্বর্গে প্রয়োজন নেই।’
ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চাও।’
তপস্বী বললে, ‘এই বনের কাঠকুড়নিকে।’
মাঘ-ফাল্গুন ১৩২৮
সুয়োরানীর সাধ
সুয়োরানীর বুঝি মরণকাল এল।
তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে, তার কিছুই ভালো লাগছে না। বদ্দি বড়ি নিয়ে এল। মধু দিয়ে মেড়ে বললে, ‘খাও।’ সে ঠেলে ফেলে দিলে।
রাজার কানে খবর গেল। রাজা তাড়াতাড়ি সভা ছেড়ে এল। পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তোমার কী হয়েছে, কী চাই।’
সে গুমরে উঠে বললে, ‘তোমরা সবাই যাও; একবার আমার স্যাঙাৎনিকে ডেকে দাও।’
স্যাঙাৎনি এল। রানী তার হাত ধরে বললে, ‘সই, বসো। কথা আছে।’
স্যাঙাৎনি বললে, ‘প্রকাশ করে বলো।’
সুয়োরানী বললে, ‘আমার সাতমহলা বাড়ির এক ধারে তিনটে মহল ছিল দুয়োরানীর। তার পরে হল দুটো, তার পরে হল একটা। তার পরে রাজবাড়ি থেকে সে বের হয়ে গেল।
তার পরে দুয়োরানীর কথা আমার মনে রইল না।
তার পরে একদিন দোলযাত্রা। নাটমন্দিরে যাচ্ছি ময়ূরপংখি চ’ড়ে। আগে লোক, পিছে লশকর। ডাইনে বাজে বাঁশি, বাঁয়ে বাজে মৃদঙ্গ।
এমনসময় পথের পাশে, নদীর ধারে, ঘাটের উপরটিতে দেখি একখানি কুঁড়েঘর, চাঁপাগাছের ছায়ায়। বেড়া বেয়ে অপরাজিতার ফুল ফুটেছে, দুয়োরের সামনে চালের গুড়া দিয়ে শঙ্খচক্রের আলপনা। আমার ছত্রধারিণীকে শুধোলেম, ‘আহা, ঘরখানি কার।’ সে বললে, দুয়োরানীর।
তার পরে ঘরে ফিরে এসে সন্ধ্যার সময় বসে আছি, ঘরে প্রদীপ জ্বালি নি, মুখে কথা নেই।
রাজা এসে বললে, ‘তোমার কী হয়েছে, কী চাই।’
আমি বললেম, ‘এ ঘরে আমি থাকব না।’
রাজা বললে, ‘আমি তোমার কোঠাবাড়ি বানিয়ে দেব গজদন্তের দেওয়াল দিয়ে। শঙ্খের গুড়ায় মেঝেটি হবে দুধের ফেনার মতো সাদা, মুক্তোর ঝিনুক দিয়ে তার কিনারে এঁকে দেব পদ্মের মালা।’