আমার স্তব শুনে বটের ভিতরকার প্রাণপুরুষ বুঝি খুশি হল; সে বলে উঠল, ‘আমি বেরিয়েছি মরুদৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে; কিন্তু আমার এক ছোটো ভাই আছে, সে যে কোন্ লড়াইয়ে কোথায় চলে গেল আমি তার আর নাগাল পাই নে। কিছুক্ষণ আগে তারই কথা কি তুমি বলছিলে।’
‘হ্যাঁ, তাকেই আমরা নাম দিয়েছি, মন।’
‘সে আমার চেয়ে চঞ্চল। কিছুতে তার সন্তোষ নেই। সেই অশান্তটার খবর আমাকে দিতে পার?’
আমি বললেম, ‘কিছু কিছু পারি বই কি। তুমি লড়ছ বাঁচবার জন্যে, সে লড়ছে পাবার জন্যে, আরও দূরে আর-একটা লড়াই চলছে ছাড়বার জন্যে। তোমার লড়াই অসাড়ের সঙ্গে, তার লড়াই অভাবের সঙ্গে, আরও একটা লড়াই আছে সঞ্চয়ের সঙ্গে। লড়াই জটিল হয়ে উঠল, ব্যূহের মধ্যে যে প্রবেশ করছে ব্যূহ থেকে বেরোবার পথ সে খুঁজে পাচ্ছে না। হার জিত অনিশ্চিত ব’লে ধাঁদা লাগল। এই দ্বিধার মধ্যে তোমার ঐ সবুজ পতাকা যোদ্ধাদের আশ্বাস দিচ্ছে। বলছে, ’জয়, প্রাণের জয়।’ গানের তান বেড়ে বেড়ে চলেছে, কোন্ সপ্তক থেকে কোন্ সপ্তকে চড়ল তার ঠিকানা নেই। এই স্বর সংকটের মধ্যে তোমার তম্বুরাটি সরল তারে বলছে, ‘ভয় নেই, ভয় নেই।’ বলছে, ’এই তো মূল সুর আমি বেঁধে রেখেছি, এই আদি প্রাণের সুর। সকল উন্মত্ত তানই এই সুরে সুন্দরের ধুয়োয় এসে মিলবে আনন্দের গানে। সকল পাওয়া, সকল দেওয়া ফুলের মতো ফুটবে, ফলের মতো ফলবে।’
ফাল্গুন ১৩২৬
বাঁশি
বাঁশির বাণী চিরদিনের বাণী—শিবের জটা থেকে গঙ্গার ধারা, প্রতি দিনের মাটির বুক বেয়ে চলেছে; অমরাবতীর শিশু নেমে এল মর্ত্যের ধূলি দিয়ে স্বর্গ-স্বর্গ খেলতে।
পথের ধারে দাঁড়িয়ে বাঁশি শুনি আর মন যে কেমন করে বুঝতে পারি নে। সেই ব্যথাকে চেনা সুখদুঃখের সঙ্গে মেলাতে যাই, মেলে না। দেখি, চেনা হাসির চেয়ে সে উজ্জ্বল, চেনা চোখের জলের চেয়ে সে গভীর।
আর, মনে হতে থাকে, চেনাটা সত্য নয়, অচেনাই সত্য। মন এমন সৃষ্টিছাড়া ভাব ভাবে কী করে। কথায় তার কোনো জবাব নেই।
আজ ভোরবেলাতেই উঠে শুনি, বিয়েবাড়িতে বাঁশি বাজছে।
বিয়ের এই প্রথম দিনের সুরের সঙ্গে প্রতি দিনের সুরের মিল কোথায়। গোপন অতৃপ্তি, গভীর নৈরাশ্য; অবহেলা, অপমান, অবসাদ; তুচ্ছ কামনার কার্পণ্য, কুশ্রী নীরসতার কলহ,ক্ষমাহীন ক্ষুদ্রতার সংঘাত, অভ্যস্ত জীবনযাত্রার ধূলিলিপ্ত দারিদ্র্য—বাঁশির দৈববাণীতে এসব বার্তার আভাস কোথায়।
গানের সুর সংসারের উপর থেকে এই-সমস্ত চেনা কথার পর্দা এক টানে ছিঁড়ে ফেলে দিলে। চিরদিনকার বর-কনের শুভদৃষ্টি হচ্ছে কোন্ রক্তাংশুকের সলজ্জ অবগুণ্ঠনতলে, তাই তার তানে তানে প্রকাশ হয়ে পড়ল।
যখন সেখানকার মালাবদলের গান বাঁশিতে বেজে উঠল তখন এখানকার এই কনেটির দিকে চেয়ে দেখলেম; তার গলায় সোনার হার, তার পায়ে দুগাছি মল, সে যেন কান্নার সরোবরে আনন্দের পদ্মটির উপরে দাঁড়িয়ে।
সুরের ভিতর দিয়ে তাকে সংসারের মানুষ ব’লে আর চেনা গেল না। সেই চেনা ঘরের মেয়ে অচিন ঘরের বউ হয়ে দেখা দিলে।
বাঁশি বলে, এই কথাই সত্য।
১৩২৬
বাণী
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে আকাশের মেঘ নামে— মাটির কাছে ধরা দেবে ব’লে। তেমনি কোথা থেকে মেয়েরা আসে পৃথিবীতে বাঁধা পড়তে।
তাদের জন্য অল্প জায়গার জগৎ অল্প মানুষের। ঐটুকুর মধ্যে আপনার সবটাকে ধরানো চাই— আপনার সব কথা, সব ব্যথা, সব ভাবনা। তাই তাদের মাথায় কাপড়, হাতে কাঁকন, আঙিনায় বেড়া। মেয়েরা হল সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী।
কিন্তু, কোন দেবতার কৌতুকহাস্যের মতো অপরিমিত চঞ্চলতা নিয়ে আমাদের পাড়ায় ঐ ছোটো মেয়েটির জন্ম। মা তাকে রেগে বলে ‘দস্যি’, বাপ তাকে হেসে বলে ‘পাগলি’।
সে পলাতকা ঝর্নার জল, শাসনের পাথর ডিঙিয়ে চলে। তার মনটি যেন বেণুবনের উপর-ডালের পাতা, কেবলই ঝির্ ঝির্ করে কাঁপছে।
২
আজ দেখি, সেই দুরন্ত মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে— বাদলশেষের ইন্দ্রধনুটি বললেই হয়। তার বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ আজ অচঞ্চল, তমালের ডালে বৃষ্টির দিনে ডানা-ভেজা পাখির মতো।
ওকে এমন স্তব্ধ কখনো দেখি নি। মনে হল, নদী যেন চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থমকে সরোবর হয়েছে।
৩
কিছুদিন আগে রৌদ্রের শাসন ছিল প্রখর; দিগন্তের মুখ বিবর্ণ; গাছের পাতাগুলো শুকনো হলদে, হতাশ্বাস।
এমন সময় হঠাৎ কালো আলুথালু পাগলা মেঘ আকাশের কোণে কোণে তাঁবু ফেললে। সূর্যাস্তের একটা রক্তরশ্মি খাপের ভিতর থেকে তলোয়ারের মতো বেরিয়ে এল।
অর্ধেক রাত্রে দেখি দরজাগুলো খড়্খড়্ শব্দে কাঁপছে। সমস্ত শহরের ঘুমটাকে ঝড়ের হাওয়া ঝুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে দিলে।
উঠে দেখি, গলির আলোটা ঘন বৃষ্টির মধ্যে মাতালের ঘোলা চোখের মতো দেখতে। আর গির্জের ঘড়ির শব্দ এল যেন বৃষ্টির শব্দের চাদর মুড়ি দিয়ে।
সকালবেলায় জলের ধারা আরও ঘনিয়ে এল— রৌদ্র আর উঠল না।
৪
এই বাদলায় আমাদের পাড়ার মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙ ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে।
তার বোন এসে তাকে বললে, ‘মা ডাকছে।’ সে কেবল সবেগে মাথা নাড়ল, তার বেণী উঠল দুলে। কাগজের নৌকো নিয়ে তার ভাই তার হাত ধ’রে টানলে; সে হাত ছিনিয়ে নিলে। তবু তার ভাই খেলার জন্যে টানাটানি করতে লাগল; তাকে এক থাপড় বসিয়ে দিলে।
৫
বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকার আরও ঘন হয়ে এল। মেয়েটি স্থির দাঁড়িয়ে।