লজ্জিত হয়ে বললেম, ‘বলেছিলেম। কিন্তু, তার পরে অনেক দিন হয়ে গেল, তার পরে কখন ভুলে গেলেম।’
সে বললে, ‘যে অর্ন্তযামীর বর, তিনি তো ভোলেন নি। আমি সেই অবধি ছায়াতলে গোপনে বসে আছি। আমাকে বরণ করে নাও।’
আমি তার হাতখানি আমার হাতে তুলে নিয়ে বললেম, ‘এ কী তোমার অপরূপ মূর্তি।’
সে বললে, ‘যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি।’
আষাঢ় ১৩২৬
প্রশ্ন
শ্মাশান হতে বাপ ফিরে এল।
তখন সাত বছরের ছেলেটি— গা খোলা, গলায় সোনার তাবিজ—একলা গলির উপরকার জানলার ধারে।
কী ভাবছে তা সে আপনি জানে না।
সকালের রৌদ্র সামনের বাড়ির নিম গাছটির আগডালে দেখা দিয়েছে; কাঁচাঅম-ওয়ালা গলির মধ্যে এসে হাঁক দিয়ে দিয়ে ফিরে গেল।
বাবা এসে খোকাকে কোলে নিলে; খোকা জিজ্ঞাসা করলে, ‘মা কোথায়।’
বাবা উপরের দিকে মাথা তুলে বললে, ‘স্বর্গে।’
২
সে রাত্রে শোকে শ্রান্ত বাপ, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্ষণে ক্ষণে গুমরে উঠছে।
দুয়ারে লণ্ঠনের মিট্মিটে আলো, দেয়ালের গায়ে একজোড়া টিকটিকি।
সামনে খোলা ছাদ, কখন খোকা সেইখানে এসে দাঁড়াল।
চারি দিকে আলো-নেবানো বাড়িগুলো যেন দৈত্যপুরীর পাহারাওয়ালা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমচ্ছে।
উলঙ্গ গায়ে খোকা আকাশের দিকে তাকিয়ে।
তার দিশাহারা মন কাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘কোথায় স্বর্গের রাস্তা।’
আকাশে তার কোনো সাড়া নেই; কেবল তারায় তারায় বোবা অন্ধকারের চোখের জল।
আশ্বিন ১৩২৬
প্রাণমন
আমার জানলার সামনে রাঙা মাটির রাস্তা।
ওখান দিয়ে বোঝাই নিয়ে গোরুর গাড়ি চলে; সাঁওতাল মেয়ে খড়ের আঁটি মাথায় করে হাটে যায়, সন্ধ্যাবেলায় কলহাস্যে ঘরে ফেরে।
কিন্তু, মানুষের চলাচলের পথে আজ আমার মন নেই।
জীবনের যে ভাগটা অস্থির, নানা ভাবনায় উদ্বিগ্ন, নানা চেষ্টায় চঞ্চল, সেটা আজ ঢাকা পড়ে গেছে। শরীর আজ রুগ্ন, মন আজ নিরাসক্ত।
ঢেউয়ের সমুদ্র বাহিরতলের সমুদ্র; ভিতরতলে যেখানে পৃথিবীর গভীর গর্ভশয্যা ঢেউ সেখানকার কথা গোলমাল করে ভুলিয়ে দেয়। ঢেউ যখন থামে তখন সমুদ্র আপন গোচরের সঙ্গে অগোচরের, গভীরতলের সঙ্গে উপরিতলের অখণ্ড ঐক্যে স্তব্ধ হয়ে বিরাজ করে।
তেমনি আমার সচেষ্ট প্রাণ যখনি ছুটি পেল, তখনি গভীর প্রাণের মধ্যে স্থান পেলুম যেখানে বিশ্বের আদিকালের লীলাক্ষেত্র।
পথ-চলা পথিক যত দিন ছিলুম তত দিন পথের ধারের ঐ বটগাছটার দিকে তাকাবার সময় পাই নি; আজ পথ ছেড়ে জানলায় এসেছি, আজ ওর সঙ্গে মোকাবিলা শুরু হল।
আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ক্ষণে ক্ষণে ও যেন অস্থির হয়ে ওঠে। যেন বলতে চায়, ‘বুঝতে পারছ না?’
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ‘বুঝেছি, সব বুঝেছি; তুমি অমন ব্যাকুল হোয়ো না।’
কিছু ক্ষণের জন্যে আবার শান্ত বয়ে যায়। আবার দেখি, ভারি ব্যস্ত হয়ে ওঠে; আবার সেই থর্থর্ ঝর্ঝর্ ঝল্মল্।
আবার ওকে ঠাণ্ডা করে বলি, ‘হাঁ হাঁ, ঐ কথাই বটে; আমি তোমারই খেলার সাথি, লক্ষহাজার বছর ধরে এই মাটির খেলাঘরে আমিও গণ্ডূষে গণ্ডূষে তোমারই মতো সূর্যালোক পান করেছি, ধরণীর স্তন্যরসে আমিও তোমার অংশী ছিলেম।’
তখন ওর ভিতর দিয়ে হঠাৎ হাওয়ার শব্দ শুনি; ও বলতে থাকে, ‘হাঁ, হাঁ, হাঁ।’
যে ভাষা রক্তের মর্মরে আমার হৃৎপিণ্ডে বাজে, যা আলো-অন্ধকারের নিঃশব্দ আবর্তন ধ্বনি, সেই ভাষা ওর পত্রমর্মরে আমার কাছে এসে পৌঁছয়। সেই ভাষা বিশ্বজগতের সরকারি ভাষা।
তার মূল বাণীটি হচ্ছে, ‘আছি, আছি; আমি আছি, আমরা আছি।’
সে ভারি খুশির কথা। সেই খুশিতে বিশ্বের অণু পরমাণু থর্থর্ করে কাঁপছে।
ঐ বটগাছের সঙ্গে আমার আজ সেই এক ভাষায় সেই এক খুশির কথা চলছে।
ও আমাকে বলছে, ‘আছ হে বটে?’
আমি সাড়া দিয়ে বলছি, ‘আছি হে মিতা।’
এমনি করে ‘আছি’তে এক তালে করতালি বাজছে।
২
ঐ বটগাছটার সঙ্গে যখন আমার আলাপ শুরু হল তখন বসন্তে ওর পাতাগুলো কচি ছিল; তার নানা ফাঁক দিয়ে আকাশের পলাতক আলো ঘাসের উপর এসে পৃথিবীর ছায়ার সঙ্গে গোপনে গলাগলি করত।
তার পরে আষাঢ়ের বর্ষা নামল; ওরও পাতার রঙ মেঘের মতো গম্ভীর হয়ে এসেছে। আজ সেই পাতার রাশ প্রবীণের পাকা বুদ্ধির মতো নিবিড়, তার কোনো ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো প্রবেশ করবার পথ পায় না। তখন গাছটি ছিল গরিবের মেয়েটির মতো; আজ সে ধনীঘরের গৃহিণী, যেন পর্যাপ্ত পরিতৃপ্তির চেহারা।
আজ সকালে সে তার মরকতমণির বিশনলী হার ঝল্মলিয়ে আমাকে বললে, ‘মাথার উপর অমনতরো ইঁটপাথর মুড়ি দিয়ে বসে আছ কেন। আমার মতো একেবারে ভরপুর বাইরে এসো-না।’
আমি বললেম, ‘মানুষকে যে ভিতর বাহির দুই বাঁচিয়ে চলতে হয়।’
গাছ নড়েচড়ে বলে উঠল, ‘বুঝতে পারলেম না।’
আমি বললেম, ‘আমাদের দুটো জগৎ, ভিতরের আর বাইরের।’
গাছ বললে, ‘সর্বনাশ! ভিতরেরটা আছে কোথায়।’
‘আমার আপনারই ঘেরের মধ্যে।’
‘সেখানে কর কী।’
‘সৃষ্টি করি।’
‘সৃষ্টি আবার ঘেরের মধ্যে! তোমার কথা বোঝবার জো নেই।’
আমি বললেম, ‘যেমন তীরের মধ্যে বাঁধা প’ড়ে হয় নদী, তেমনি ঘেরের মধ্যে ধরা প’ড়েই তো সৃষ্টি। একই জিনিস ঘেরের মধ্যে আটকা প’ড়ে কোথাও হীরের টুকরো, কোথাও বটের গাছ।’
গাছ বললে, ‘তোমার ঘেরটা কী রকম শুনি।’
আমি বললেম, ‘সেইটি আমার মন। তার মধ্যে যা ধরা পড়ছে তাই নানা সৃষ্টি হয়ে উঠছে।’
গাছ বললে, ‘তোমার সেই বেড়াঘেরা সৃষ্টিটা আমাদের চন্দ্রসূর্যের পাশে কতটুকুই বা দেখায়।’