রাজা অধ্যাপককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার ছাত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে।’
অধ্যাপক বললেন, ‘রুচিরা।’
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর কৌশিক?’
অধ্যাপক বললেন, ‘সে যে কিছুই শিখেছে এমন বোধ হয় না।’
রাজা বললেন, ‘আমি কৌশিকের সঙ্গে রুচির বিবাহ ইচ্ছা করি।’
অধ্যাপক একটু হাসলেন; বললেন, ‘এ যেন গোধূলির সঙ্গে উষার বিবাহের প্রস্তাব।’
রাজা মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘তোমার কন্যার সঙ্গে কৌশিকের বিবাহে বিলম্ব উচিত নয়।’
মন্ত্রী বললে, ‘মহারাজ, আমার কন্যা এ বিবাহে অনিচ্ছুক।’
রাজা বললেন, ‘স্ত্রীলোকের মনের ইচ্ছা কি মুখের কথায় বোঝা যায়।’
মন্ত্রী বললে, ‘তার চোখের জলও যে সাক্ষ্য দিচ্ছে।’
রাজা বললেন, ‘সে কি মনে করে কৌশিক তার অযোগ্য।’
মন্ত্রী বললে, ‘হাঁ, সেই কথাই বটে।’
রাজা বললেন, ‘আমার সামনে দুজনের বিদ্যার পরীক্ষা হোক। কৌশিকের জয় হলে এই বিবাহ সম্পন্ন হবে।’
পরদিন মন্ত্রী রাজাকে এসে বললে, ‘এই পণে আমার কন্যার মত আছে।’
৪
বিচারসভা প্রস্তুত। রাজা সিংহাসনে ব’সে, কৌশিক তাঁর সিংহাসনতলে।
স্বয়ং অধ্যাপক রুচিকে সঙ্গে করে উপস্থিত হলেন। কৌশিক আসন ছেড়ে উঠে তাঁকে প্রণাম ও রুচিকে নমস্কার করলে। রুচি দৃক্পাত করলে না।
কোনোদিন পাঠশালার রীতিপালনের জন্যেও কৌশিক রুচির সঙ্গে তর্ক করে নি। অন্য ছাত্রেরাও অবজ্ঞা করে তাকে তর্কের অবকাশ দিত না। তাই আজ যখন তার যুক্তির মুখে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ তীরের ফলায় আলোর মতো ঝিক্মিক্ করে উঠল তখন গুরু বিস্মিত হলেন, এবং বিরক্ত হলেন। রুচির কপালে ঘাম দেখা দিল, সে বুদ্ধি স্থির রাখতে পারলে না। কৌশিক তাকে পরাভবের শেষ কিনারায় নিয়ে গিয়ে তবে ছেড়ে দিলে।
ক্রোধে অধ্যাপকের বাক্রোধ হল, আর রুচির চোখ দিয়ে ধারা বেয়ে জল পড়তে লাগল।
রাজা মন্ত্রীকে বললেন, ‘এখন, বিবাহের দিন স্থির করো।’
কৌশিক আসন ছেড়ে উঠে জোড় হাতে রাজাকে বললে, ‘ক্ষমা করবেন, এ বিবাহ আমি করব না।’
রাজা বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘জয়লব্ধ পুরস্কার গ্রহণ করবে না?’
কৌশিক বললে, ‘জয় আমারই থাক্, পুরস্কার অন্যের হোক।’
অধ্যাপক বললেন, ‘মহারাজ, আর এক বছর সময় দিন, তার পরে শেষ পরীক্ষা।’
সেই কথাই স্থির হল।
৫
কৌশিক পাঠশালা ত্যাগ করে গেল। কোনোদিন সকালে তাকে বনের ছায়ায়, কোনোদিন সন্ধ্যায় তাকে পাহাড়ের চূড়ার উপর দেখা যায়।
এ দিকে রুচির শিক্ষায় অধ্যাপক সমস্ত মন দিলেন। কিন্তু, রুচির সমস্ত মন কোথায়।
অধ্যাপক বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এখনও যদি সতর্ক না হও তবে দ্বিতীয়বার তোমাকে লজ্জা পেতে হবে।’
দ্বিতীয়বার লজ্জা পাবার জন্যেই যেন সে তপস্যা করতে লাগল। অপর্ণার তপস্যা যেমন অনশনের, রুচির তপস্যা তেমনি অনধ্যায়ের। ষড়্দর্শনের পুঁথি তার বন্ধই রইল, এমন কি কাব্যের পুঁথিও দৈবাৎ খোলা হয়।
অধ্যাপক রাগ করে বললেন, ‘কপিল-কণাদের নামে শপথ করে বলছি, আর কখনো স্ত্রীলোক ছাত্র নেব না। বেদবেদান্তের পার পেয়েছি, স্ত্রীজাতির মন বুঝতে পারলেম না।’
একদা মন্ত্রী এসে রাজাকে বললে, ‘ভবদত্তর বাড়ি থেকে কন্যার সম্বন্ধ এসেছে। কুলে শীলে ধনে মানে তারা অদ্বিতীয়। মহারাজের সম্মতি চাই।’
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কন্যা কী বলে।’
মন্ত্রী বললে, ‘মেয়েদের মনের ইচ্ছা কি মুখের কথায় বোঝা যায়।’
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তার চোখের জল আজ কী রকম সাক্ষ্য দিচ্ছে।’
মন্ত্রী চুপ করে রইল।
৬
রাজা তাঁর বাগানে এসে বসলেন। মন্ত্রীকে বললেন, ‘তোমার মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’
রুচিরা এসে রাজাকে প্রণাম করে দাঁড়াল।
রাজা বললেন, ‘বৎসে, সেই রামের বনবাসের খেলা মনে আছে?’
রুচিরা স্মিতমুখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
রাজা বললেন, ‘আজ সেই রামের বনবাস খেলা আর-একবার দেখতে আমার বড়ো সাধ।’
রুচিরা মুখের এক পাশে আঁচল টেনে চুপ করে রইল।
রাজা বললেন, ‘বনও আছে, রামও আছে, কিন্তু শুনছি বৎসে, এবার সীতার অভাব ঘটেছে। তুমি মনে করলেই সে অভাব পূরণ হয়।’
রুচিরা কোনো কথা না ব’লে রাজার পায়ের কাছে নত হয়ে প্রণাম করলে।
রাজা বললেন, ‘কিন্তু, বৎসে, এবার আমি রাক্ষস সাজতে পারব না।’
রুচিরা স্নিগ্ধ চক্ষে রাজার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
রাজা বললেন, ‘এবার রাক্ষস সাজবে তোমাদের অধ্যাপক।’
জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯
পুরোনো বাড়ি
অনেক কালের ধনী গরিব হয়ে গেছে, তাদেরই ঐ বাড়ি।
দিনে দিনে ওর উপরে দুঃসময়ের আঁচড় পড়ছে।
দেয়াল থেকে বালি খসে পড়ে, ভাঙা মেঝে নখ দিয়ে খুঁড়ে চড়ুইপাখি ধুলোয় পাখা ঝাপট দেয়, চণ্ডীমণ্ডপে পায়রাগুলো বাদলের ছিন্ন মেঘের মতো দল বাঁধল।
উত্তর দিকের এক পাল্লা দরজা কবে ভেঙে পড়েছে কেউ খবর নিলে না। বাকি দরজাটা, শোকাতুরা বিধবার মতো, বাতাসে ক্ষণে ক্ষণে আছাড় খেয়ে পড়ে—কেউ তাকিয়ে দেখে না।
তিন মহল বাড়ি। কেবল পাঁচটি ঘরে মানুষের বাস, বাকি সব বন্ধ। যেন পঁচাশি বছরের বুড়ো, তার জীবনের সবখানি জুড়ে সেকালের কুলুপ-লাগানো স্মৃতি, কেবল একখানিতে একালের চলাচল।
বালি-ধসা ইঁট-বের-করা বাড়িটা তালি-দেওয়া-কাঁথা-পরা উদাসীন পাগলার মতো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে; আপনাকেও দেখে না, অন্যকেও না।
২
একদিন ভোররাত্রে ঐদিকে মেয়ের গলায় কান্না উঠল। শুনি, বাড়ির যেটি শেষ ছেলে, শখের যাত্রায় রাধিকা সেজে যার দিন চলত, সে আজ আঠারো বছরে মারা গেল।