অবলাকান্ত ক্যাবলাকান্তের মতন তাকিয়ে আছেন, এমন সময়ে ঠিক তার কাছ থেকে হাত চারেক তফাতেই আবার কে ফাঁচ-ফাঁচ-ফাঁচ করে তিন-তিনবার হেঁচে উঠল।
অবলাকান্তের মুখ সাদা হয়ে গেল। বিড়বিড় করে তিনি বললেন, এ কে হচে? আকাশ, না বাতাস, না পাহাড়? না যক্ষ রক্ষ দেবতা দানব? এরকম হাঁচি তো ভালো নয়? এই বলে তিনি তাড়াতাড়ি কবিতার খাতা মুড়ে ফেলে শ্রীপুরের দিকে দ্রুত পদ-চালনা করলেন।
.
অষ্টম। বাবু বংশীবদন বসু
কেউ তাকে নাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, আমার নাম বাবু বংশীবদন বসু। পাছে তিনি আমাদের উপরে রাগ করেন, সেইজন্যে আমরাও তাকে বংশীবাবু বলেই ডাকব।
বংশীবাবুর ভোজন হয় যত্র-তত্র, আর শয়ন হয় হট্টমন্দিরে, তারপরে যে-সময়টুকু হাতে থাকে হাটে-ঘাটে-মাঠে টো-টো করে ঘুরে, বংশীবাবু সে-সময়টুকু কাটিয়ে দিতে পারেন অনায়াসেই।
মস্ত মাঠ। একটা বটগাছের ছায়ায় নরম ঘাসের উপরে বংশীবাবু দুপা ছড়িয়ে বসেছিলেন। তাঁর সামনে সাজানো ছিল সারি সারি চার জোড়া ছেঁড়া জুতোর পাটি।
বংশীবাবুর সম্প্রতি পায়ের জুতোর অভাব হয়েছে। কিন্তু সে অভাব পূরণ করতে তাঁর বেশিক্ষণ লাগেনি। শহরের বাড়ি বাড়ি ঘুরে এই চার জোড়া ছেঁড়া জুতো তিনি আজ সংগ্রহ করে এনেছেন। আর এখন বসে বসে পরীক্ষা করছেন, এই চার জোড়া জুতোর মধ্যে কোন জোড়া সবচেয়ে ছেঁড়া!
হঠাৎ কে পিছন থেকে বললে, ওগুলো, জুতো বুঝি? বংশীবাবু পিছনে না তাকিয়েই বললেন, হ্যাঁ এ বিষয়ে কোনওই সন্দেই নেই। এগুলি হচ্ছে দাঁতব্য জুতো। এর চেয়ে খারাপ চার জোড়া জুতো দুনিয়াতে কেউ আবিষ্কার করতে পারবে না।
পিছনের লোকটি বললে, হুঁ।
বংশীবাবু বললেন, অবশ্য এর চেয়েও খারাপ জুতো যে আমি পরিনি তা নয়, কিন্তু তবু, সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এ-শহরে যারা জুতো দান করে তারা খুব দয়ালু লোক নয়!
পিছনের লোকটি বললে, দুনিয়ায় যারা সবচেয়ে পাজি লোক, এ-শহরে বাস করে তারাই।
কে এতটা স্পষ্ট কথা কইছে দেখবার জন্যে বংশীবাবু ডান কাঁধের উপরে মুখ ফিরিয়ে পিছন-পানে তাকালেন। সেদিকে, কেউ নেই। তারপর তিনি বাঁ কাঁধের উপরে মুখ ফিরিয়ে পিছন পানে তাকালেন। সেদিকেও কেউ নেই। তারপর তিনি একেবারে ঘুরে বসলেন। কোথাও কেউ নেই।
বংশীবাবু নিজের মনে বললেন, আমি কি জেগে-জেগেই স্বপ্ন দেখছি?
সেই কণ্ঠস্বর বললে, ভয় পেও না।
বংশীবাবু আঁতকে উঠে বললেন, কে তুমি বাবা? কোথায় তুমি? কেউ কি তোমাকে মাটির ভেতরে পুঁতে রেখে গিয়েছে?
কণ্ঠস্বর আবার বললে, ভয় পেও না।
হতভম্ব বংশীবাবু বললেন, বল কি বাবা, ভয় পাব না কীরকম? উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব পশ্চিম সব খাঁ-খাঁ করছে। এই তেপান্তরে আমি আছি একলা। অথচ এখানে এসে তুমি কথা কইছ কোনখান থেকে?…না, তুমি বোধ হয় নেই! কাল রাতে সিদ্ধি খেয়েছিলুম, এখনও নেশা কাটেনি। ভুল শুনছি।
কণ্ঠস্বর বললে, না, এ নেশা নয়।
বাপ রে। বলেই এক লাফে বংশীবাবু দাঁড়িয়ে উঠলেন। একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পিছু হটতে হটতে বললেন, না নিশ্চয়ই আমার নেশা কাটেনি! দিব্যি গেলে বলতে পারি, আমি এখুনি কার গলা শুনলুম!
কণ্ঠস্বর বললে, হ্যাঁ, তুমি আমারই গলার আওয়াজ শুনেছ।
ভয়ে দুই চোখ মুদে ফেলে বংশীবাবু বললেন, আর কখনও আমি সিদ্ধি খাব না।
হঠাৎ কে তার দুই কঁধ ধরে খুব খানিকটা আঁকুনি দিয়ে বললে, তুমি একটা মস্ত গাধা।
বংশীবাবু চোখ না খুলেই বললেন, আমি গাধা হতেও রাজি আছি বাবা, তুমি যদি দয়া করে চুপ করো। এখন যদি রাত হত তাহলে এসব ভূতেরই খেলা বলে মনে করতুম।
কণ্ঠস্বর বললে, ওহে বোকারাম, আমি ভূত-টুত কিছু নই,আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ।
বংশীবাবু চোখ খুলে বললেন, অদৃশ্য মানুষ? না নেশার খেয়াল?
কণ্ঠস্বর বললে, নেশার খেয়াল নয়, আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ!
তুমি যে অদৃশ্য সেটা আমি বুঝতেই পারছি বাবা! কিন্তু তুমি কোন মন্ত্রে অদৃশ্য হয়েছ সেটা আমাকে শিখিয়ে দিতে পারো?
পারি। যদি তুমি আমার কথা শোনো।
ও-মন্ত্র পেলে তোমার জন্যে আমি সব করতে পারি।
দেখ, আমিও তোমার মতন ভবঘুরে। আমি অসহায়। আমার মাথা গোঁজবার ঠাই নেই। সারাদিন আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে রাগে আমার সর্বশরীর জ্বলছে। মানুষ পেলেই এখুনি আমি খুন করতে পারি!
বাবা! বলেই বংশীবাবু পালিয়ে যাওয়ার উপক্রম করলেন!
খপ করে বংশীবাবুর একখানা হাত ধরে অদৃশ্য মানুষ বললে, তোমার কোনও অনিষ্টই আমি করব না! আমি জামা-কাপড় চাই, আশ্রয় চাই, খোরাক চাই। এই-সব বিষয়ে তুমি আমাকে সাহায্য করবে!
বংশীবাবু ভাবতে লাগলেন, যার নিজের পরনের কাপড়, পেটের অন্ন আর মাথা গোঁজবার ঠাই জোটে না, এইসব বিষয়ে সে কিনা সাহায্য করবে অপরকে! কিন্তু ভয়ে মনের কথা তিনি মুখ ফুটে বলতে পারলেন না!
কণ্ঠস্বর বললে, আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ–সমস্ত পৃথিবীকে আমি শাসন করতে পারি। আমাকে সাহায্য করলে তোমার কোনও অভাবই থাকবে না! কিন্তু সাবধান, আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে পৃথিবীতে কেউ তোমাকে রক্ষে করতে পারবে না! বলতে বলতে সে। তার অদৃশ্য দুই হাত দিয়ে বংশীবাবুর দুখানা হাত সজোরে চেপে ধরলে।
বংশীবাবু যাতনায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন, ছেড়ে দাও বাবা! আমি তোমার গোলাম থাকব!