বৈঠকখানায় মহা হুড়োহুড়ি লেগে গেল–চিৎকার, কান্না, আর্তনাদ! মিসেস দাস আঁ বলে চেঁচিয়ে উঠে প্রচণ্ড গতর নিয়ে পালাতে গিয়ে দড়াম করে এক আছাড় খেলেন কিন্তু সেই অবস্থাতেই আশ্চর্য কৌশলে ফুটবলের মতো গড়াতে গড়াতে চোখের নিমেষে তিনি কোথায়। অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বাকি লোকেরাও কে যে কেমন করে কোন দিকে সরে পড়ল, কিছুই বোঝা গেল না। আধ মিনিটেই ঘর একেবারে খালি।
স্কন্ধকাটা মূর্তিটা মিনিটখানেক সেখানে পায়চারি করে আবার বাড়ির ভিতরে চলে গেল। ধীরে ধীরে।
এ-খবর শ্রীপুরের পাড়ায় পাড়ায় রটে যেতে বেশি দেরি লাগল না! চড়কের মেলার কথা সবাই ভুলে গেল–আধঘণ্টার ভিতরে শহরের সমস্ত জনতা স্বাস্থ্যনিবাসের সামনে এসে হাজির। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মুখে কেবল একই কথা–জুজু! জুজু! জুজু! স্বাস্থ্যনিবাসে জুজুবুড়ো এসেছে!
এমন সময়ে দুজন চৌকিদার ও দারোগাকে সঙ্গে করে মিস্টার দাস, রতনবাবু আর মানিকবাবু বিজয়ী বীরের মতন সদর্পে স্বাস্থ্যনিবাসে এসে ঢুকলেন।
দারোগা শুধোলেন, কোথায় সে লোক?
এই যে, এই দিকে আসুন।বলে মিস্টার দাস সবাইকে নিয়ে যাত্রীর ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন।
সেই স্কন্ধকাটা মূর্তি ঘরের মাঝখানে একখানা চেয়ারের উপরে স্থির হয়ে বসেছিল।
বলা বাহুল্য, প্রথমে সকলেই ভড়কে গেল মিস্টার দাস, রতনবাবু ও মানিকবাবু তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এসে, দরকার হলেই পালাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে রইলেন।
দারোগা বললেন, ওসব ম্যাজিক আমি ঢের দেখেছি। আমার হাতে যখন ওয়ারেন্ট আছে, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব সবাইকে আমি গ্রেপ্তার করতে পারি! –এই বলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন।
স্কন্ধকাটা যাত্রী বললে, কে তোমরা? কী চাও?
দারোগা বললেন, তোমাকে গ্রেপ্তার করব!
যাত্রী উঠে দাঁড়াল। দারোগা এক লাফে যাত্রীর কাছে গিয়ে তার দস্তানাপরা একখানা হাত চেপে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে দস্তানাটা দারোগার হাতে খুলে এল এবং যাত্রীর হাতখানা একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু তখন আর কারুর এসব দেখে আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ ছিল নাদারোগা ও চৌকিদারেরা সেই হস্তহীন স্কন্ধকাটা মূর্তিটাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরলে।
মুখহীন মুখ থেকে আওয়াজ–ওঃ বড় লাগছে! তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, আমি আত্মসমর্পণ করছি।
দারোগা ও চৌকিদারেরা যাত্রীকে ছেড়ে দিয়ে তাকে আগলে দাঁড়িয়ে রইল।
দারোগা বললে, নাও, এখন হাতকড়ি পরো।
যাত্রী বললে, কেন, আমি কি দোষ করেছি? আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য হওয়া কি অপরাধ?
দারোগা টিটকিরি দিয়ে বললে, কি বললে? অদৃশ্য মানুষ? ম্যাজিকে আমি অমন ঢের ঢের অদৃশ্য মানুষ দেখেছি! আমার সঙ্গে ওসব চালাকি চলবে না!
যাত্রী বললে, আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করছেন না? এই দেখুন!বলেই সে নিজের গায়ের আলোয়ান চটপট খুলে ছিঁড়ে ফেলে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের উপর দিকটা অদৃশ্য হয়ে গেল! তারপরেই সে পরনের কাপড়খানা খুলতে লাগল!
দারোগা এতক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অবাক হয়ে এই সব দেখছিলেন। এখন যাত্রীকে কাপড় খোলবার চেষ্টা করতে দেখেই তিনি তার আসল মতলব খানা বুঝতে পেরে বলে উঠলেন, এই চৌকিদার! ওকে ভালো করে চেপে ধরে থাক-নইলে কাপড় খুললেই ও একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে!
কিন্তু তার আগেই যাত্রী কাপড়খানা খুলে ফেলে এক লাফে তাদের নাগালের বাইরে গিয়ে পড়ল! তখন দেখা গেল, কেবল জুতো মোজা পরা দুখানা হাঁটু পর্যন্ত পা ঘরময় লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে। পরমুহূর্তে অদৃশ্য মানুষ তার জুতো মোজাও খুলে ফেললে এবং জুতোর একপাটি মিস্টার দাসের দিকে ও আর একপাটি দারোগার দিকে সজোরে ছুঁড়ে মারলে।
তারপর সে-এক অপূর্ব দৃশ্য! ঘরের ভিতরে মহা শোরগোল পড়ে গেল! –ওই– ওইদিকে সে গিয়েছে!–বাপরে বাপ, আমায় লাথি মারলে!–ব্যাটা আমাকে ঘুষি মেরেছে! এইবারে তাকে ধরেছি! ওই যাঃ! আবার পালিয়ে গেল! ওরে বাপরে, গেছি রে!
অদৃশ্য মানুষ কখন যে কোন দিকে যাচ্ছে, কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না, মাঝখান থেকে কিল-চড়-ঘুষি-লাথি খেয়ে প্রত্যেকেরই প্রাণ যায় যায় হয়ে উঠল! বেদম প্রহার খেয়ে দারোগাবাবু তো মেঝের উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন, রতনবাবুর গোঁফের একপাশ একদম উড়ে গেল এবং মিস্টার দাসের উপর-পাটির তিন-তিনটে দাঁতের আর কোনও সন্ধানই পাওয়া গেল না!
তারপরেই প্রথমে ঘরের দরজার কাছে এবং তারপরেই সিঁড়ির উপরে দুমদুম শব্দ শুনে সকলেই বুঝতে পারলে অদৃশ্য মানুষ সে ঘরথেকে সকলের অগোচরে চলে গেল।
তখন স্বাস্থ্যনিবাসের সামনে যে জনতা এসে জমা হয়েছিল, তার ভিতরে এক বিষম বিভীষিকার সাড়া উঠল!–অদৃশ্য মানুষ রাস্তায় এসেছে! অদৃশ্য মানুষ রাস্তায় এসেছে প্রত্যেকেই এই কথা বলতে বলতে মহাভয়ে পালিয়ে যেতে লাগল।
শহরের বাইরেই ছোট একটি নদী পাহাড়ের কোল দিয়ে ঝিরঝির করে বয়ে যাচ্ছে। সেই নদীর ধারে আতাগাছের ছায়ায় একখানা পাথর-আসনে বসে শ্রীপুরের মহাকবি অবলাকান্ত একমনে কবিতা রচনা করছিলেন।
অবলাকান্ত হঠাৎ চমকে উঠলেন–ঠিক তার পাশেই ফাঁচ করে কে হেঁচে ফেললে! অবলাকান্ত একবার সামনে, একবার পিছনে, একবার ডাইনে ও একবার বামে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলেন কিন্তু হাঁচির মালিকের একগাছা টিকিও দেখা গেল না।