দুজনে ঘরের ভিতরে ঢুকলেন। যাত্রীর জুতো, জামা, কাপড়, আলোয়ান ও সেই বিশি ব্যান্ডেজগুলো ঘরের মেঝেয়, টেবিলের ও বিছানার উপরে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে!
আচম্বিতে তাঁরা স্তম্ভিত চক্ষে দেখলেন, জুতোজোড়া প্রথমে সজীব হয়ে নড়ে উঠল, তারপর গটগট করে বিছানার কাছে গিয়ে থেমে পড়ল!
মিসেস দাস হতভম্বের মতন দুই চোখ দু-হাতে রগড়ে আবার ভালো করে চাইতেই দেখলেন, যাত্রীর ঠুলি চশমাখানা শুন্যে স্থির হয়ে তার দিকেই যেন কটমট করে চেয়ে আছে!
তারপরেই ঘরের টেবিলটা হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে হড়াৎ করে এগিয়ে এসে মিস্টার দাসকে মারলে এক বিষমধাক্কা!
তারপরেই চেয়ারখানা হঠাৎ শূন্যে লাফিয়ে উঠল এবং বেগে মিসেস দাসের দিকে তেড়ে এল! কিন্তু মিসেস দাস চেয়ারের মনোবাসনা পূর্ণ করলেন না, তিরের মতন ছুটে ঘরের ভিতর থেকে পালিয়ে গেলেন। তার স্ত্রী যে এমন বেগে ছুটতে পারেন, মিস্টার দাস এতদিনেও তা জানতে পারেননি। বলা বাহুল্য তিনিও আর সে-ঘরে রইলেন না।
মিসেস দাস নিজের ঘরের সুমুখে গিয়ে মাটির উপরে ধড়াস করে আছাড় খেয়ে পড়লেন এবং সে অবস্থায় যেমন করে চাচানো উচিত, ঠিক তেমনি করেই চাচাতে কিছুমাত্র কসুর করলেন না।
সে-রাত্রে সমস্ত স্বাস্থ্যনিবাসের ঘুম ভেঙে গেল। সকলেই ঘটনাস্থলে ছুটে এল। জিজ্ঞাসা করতে লাগল–কি হয়েছে? আগুন লেগেছে? ডাকাত পড়েছে নাকি? প্রভৃতি।
মিসেস দাস হাপুস চোখে কাঁদতে কাঁদতে হাত নেড়ে নেড়ে বিনিয়ে বিনিয়ে বললেন, হায়, হায়, হায়,! ও চেয়ার যে আমার বাবার দেওয়া গো! অমন পুরোনো আর বিশ্বাসী। চেয়ার কিনা আজ আমাকেই তেড়ে এল? ওগো, আমাদের ওই ব্যান্ডেজ বাঁধা নতুন ভাড়াটেটা ভুতের সর্দার! তার মন্ত্রে আমার পুরোনো টেবিল-চেয়ারের ঘাড়ে ভূত চেপেছে! সারা ঘর জুড়ে টেবিল আর চেয়ার নাচ আরম্ভ করেছে। আমি কেতাবে পড়েছি, ভূতে পেলেই টেবিল চেয়ার জ্যান্ত হয়ে নাচতে থাকে।
মিস্টার দাস বললেন, হ্যাঁ, কেতাবে আমিও টেবিল-চেয়ার জ্যান্ত হওয়ার কথা পড়েছি বটে! কিন্তু খালি জুতো যে জ্যান্ত হয়ে নিজেই হাঁটাহাঁটি শুরু করে, কেতাবে এমন কথা তো কখনও পড়িনি!
মিসেস দাস বললেন, আর সেই চশমাখানা? সেখানাও তো ঘরময় পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছিল! মা-গো মা, এমন অনাসৃষ্টি কেউ কখনও দেখেছে না শুনেছে?
সকলে মিলে দাঁড়িয়ে গোলমাল করছে, এমন সময় যাত্রী উপর থেকে নেমে সেইখানে এসে দাঁড়াল। কর্কশ স্বরে বললে, এত গোলযোগ কীসের শুনি? রাতটা সৃষ্টি হয়েছে ঘুমোবার জন্যে, চিৎকার করবার জন্যে নয়। এসব আমি সহ্য করব না। এই বলে সে আবার সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
সকলে সভয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইল–এমনকী মিসেস দাস পর্যন্ত আর উচ্চৈস্বরে নিজের মতামত প্রকাশ করতে সাহস করলেন না।
.
সপ্তম । যাত্রীর ছদ্মবেশ ত্যাগ
পরদিন শ্রীপুর শহরে ছিল চড়কের উৎসব। রাজপথে আশেপাশে খোলা জমির উপরে মেলা বসেছে নানা জায়গা থেকে নানা দোকানি-পসারি নানানরকম রংচঙে লোভনীয় জিনিস এনে সাজিয়ে রেখেছে। নাগরদোলায় চড়ে কোথাও ছেলেমেয়ের দল হাসিখুশির গোলমাল করছে, কোথাও বায়োস্কোপের তাঁবু খাটানো হয়েছে এবং কোথাও বা ম্যাজিক দেখানো হচ্ছে। রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য।
এদিকে স্বাস্থ্যনিবাসের বৈঠকখানায় তখনও সবাই মিলে ঘোঁট পাকিয়ে তুলছে। মিস্টার দাস এসব আজেবাজে কথায় সময় নষ্ট না করে থানায় খবর দিতে বেরিয়ে গেলেন।
খানিক পরে উপর তলা থেকে কর্কশ কণ্ঠের আওয়াজ এলমিসেস দাস, মিসেস দাস!
সে-ডাক বৈঠকখানায় মিসেস দাসের কানে গেল বটে, কিন্তু তার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হল না যে, তিনি কিছু শুনতে পেয়েছেন!
খানিক পরে যাত্রী আবার ক্রুদ্ধ স্বরে হাঁকলে–মিসেস দাস! শীগগির আমার খাবার পাঠিয়ে দিন!
মিসেস দাস তবু কোনওরকম ব্যস্ততা প্রকাশ করলেন না,–এক মনে তার ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে চেয়ার-টেবিলের অদ্ভুত নৃত্য কাহিনি নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।
খানিক পরে যাত্রী নিজেই নীচে নেমে এল। মিসেস দাসের সামনে এসে একটা গোল টেবিলের উপরে সজোরে করাঘাত করে বললে, মিসেস দাস! আপনি কি মনে করেন, আমি হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকবার জন্যে স্বাস্থ্যনিবাসে এসেছি?
এইবার মিসেস দাসের মুখ ফুটল। তিনিও টেবিলের উপরে সমান জোরে চড় মেরে বলে উঠলেন, আপনি কি মনে করেন, ভূত নামাবার জন্য আপনাকে আমি ঘর ছেড়ে দিয়েছি?
যাত্রী বললে, আপনার কথার অর্থ কি?
মিসেস দাস বললেন, আপনার জন্যে আমার বিশ্বাসী টেবিল-চেয়ার পর্যন্ত আমাকে আর গিন্নি বলে মানে না! নাচবার জন্যে টেবিল-চেয়ার তৈরি করা হয়নি! কে ওদের এমন নাচতে শেখালে? কে আপনি? আপনার নাম কী? আমার ঘরে বসে আপনি কী করেন? কাল অত রাত্রে বাইরে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? আর ফিরে এলেনই বা কেমন করে?
বিষম রাগে যাত্রীর দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগল! হঠাৎ ভীষণ চিৎকার করে সে বলে উঠল, চুপ করো! কে আমি? তোমরা জানতে চাও? তোমরা দেখতে চাও? দেখো তবে!বলেই সে তার মুখের ব্যান্ডেজে মারলে এক টান! ব্যান্ডেজ, ঠুলি-চশমা, নকল গোঁফ দাড়ি আর তার নকল নাকটা সকলের চোখের সামনে খসে পড়ল! সবাই দারুণ আতঙ্কে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলে–একটা জামা-কাপড়-পরা মূর্তি পায়ে পায়ে ক্রমেই এগিয়ে আসছে কিন্তু সে মূর্তির স্কন্ধের উপরে মুখমণ্ডলের কোনও চিহ্নই নেই।