মানিকবাবু ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বললেন, কিগো, কি হয়েছে?
চোর, চোর! বাড়িতে চোর এসেছে!
চোর নামে কি জাদু আছে! এক পলকে মানিকবাবুর সব জড়তা কেটে গেল, এক লাফে ঘরের কোণে গিয়ে একগাছা মোটা লাঠি তুলে নিয়ে, মাথার উপরে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি বললেন, কোথায় সেই বদমাইশ? দেখিয়ে দাও আমাকে!
স্বামীর বীরত্ব দেখে বিমলা আশ্বস্ত হলেন না, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আপাতত তোমার লাঠি ঘোরানো থামাও। চোর এ-ঘরে নেই।
মানিকবাবু স্ত্রীর কথামতো কাজ করে বললেন, তবে সে হতভাগা কোথায়?
বিমলা বললেন, পাশের ঘরে। চুপিচুপি আমার সঙ্গে এসো, নইলে তাকে ধরতে পারবে না।
দুজনে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই শুনলেন, অন্ধকারে ফ্যাচ করে কে হেঁচে ফেললে। তারপরেই সুইচ টিপে কে আলো জ্বাললে। তারপরেই শোনা গেল কে যেন দেরাজের দরজাটা টেনে খুলে ফেললে।
মানিকবাবু একেই তো চোর-টোর পছন্দ করতেন না, তার উপরে যখন তার মনে পড়ল, দেরাজের ভিতরে আজ সকালেই তিনি পঁয়ত্রিশখানা দশ টাকার নোট রেখে দিয়েছেন, তখন আর কিছুতেই তিনি শান্ত হয়ে থাকতে পারলেন না। কে রে, কে রে বলে বিকট স্বরে চাঁচাতে চাঁচাতে এবং লাঠি ঘোরাতে-ঘোরাতে মহাবেগে তিনি ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন!
বিমলাও ঘরে ঢুকে বললেন, ওগো থামো–থামো!
কিন্তু মানিকবাবু থামলেন না, দ্বিগুণ উৎসাহেই লাঠি ঘোরাতে লাগলেন।
বিমলা আবার বললেন, ওগো মহাবীর, আর লাঠি ঘুরিয়ে কাজ নেই! চোর পালিয়েছে!
লাঠি ঘোরানো থামিয়ে মানিকবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, পালিয়েছে। কোন দিক দিয়ে পালাল?
বিমলা বললেন, জানি না।
মানিকবাবু অবাক হয়ে চারিদিকে চেয়ে দেখলেন, সত্যই ঘরের মধ্যে কেউ নেই! এ ঘরের দরজা তো মোটে একটি, আর তার সামনে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন তারা দুজনে। তবে চোর পালাল কোনদিক দিয়ে?
মানিকবাবু বললেন, কিন্তু তখন ঘরের ভেতরে হাঁচলে কে?
বিমলা বললেন, আর ঘরের ভেতরে সুইচ টিপে আলো জ্বাললে কে?
মানিকবাবু বললেন, আর দেরাজটাই বা খুললে কে?
বিমলা দেরাজের কাছে গিয়ে উঁকি মেরে বললেন, আর তোমার দেরাজের ভেতর। থেকে সাড়ে তিনশো টাকাই বা গেল কোথায়?
এসব কথার উত্তর কেউ দিল না বটে, কিন্তু ঘরের ভিতরেই কে আবার ফাঁচ করে হেঁচে ফেললে।
মানিকবাবু ও বিমলা ভয়ানক চমকে উঠলেন।
তারপরেই তারা হতভম্ব হয়ে দেখলেন, ঘরের দরজাটা আপনা-আপনি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল–ও সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল বাহির থেকে দরজায় কে শিকল তুলে দিলে।
বিমলা দৌড়ে গিয়ে দরজাটা টেনে বললেন, দরজা কে বন্ধ করে দিয়ে গেছে!
মানিকবাবুর হাত থেকে প্রথমে লাঠি খসে পড়ল, তারপর তিনি নিজেও কাঁপতে কাঁপতে মাটির উপরে বসে পড়লেন এবং তারপর কপালে দুই চোখ তুলে তিনি বললেন, গিন্নি! হাত নেই–খালি জামার হাতা! মানুষ নেই–তবু হাঁচি! চোর নেই–তবু টাকা লোপাট! গিন্নি, আমাকে তুমি ধরো আমার ঘাড়ে আজ ভূতে ভর করেছে! বলেই তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
বিমলা স্বামীর কাছে গিয়ে বসে পড়তে পড়তে শুনতে পেলেন ঘরের বাইরে কে খিলখিল করে হেসে উঠল।
.
ষষ্ঠ । টেবিল-চেয়ারের নাচ
যে-সময়ে মানিকবাবু চোখ কপালে তুলে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, ঠিক সেই সময়ে স্বাস্থ্যনিবাসের আর এক দৃশ্যের অবতারণা হল।
মিসেস দাসের শরীর অনেক রাত্রে হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়াতে, মিস্টার দাস একটা ওষুধের খোঁজে বৈঠকখানায় দিকে গেলেন।
যাত্রীর ঘরের সুমুখ দিয়ে যাওয়ার সময় মিস্টার দাস অবাক হয়ে দেখলেন, সে-ঘরের দরজা খোলা রয়েছে।
তাঁর কেমন সন্দেহ হল। দরজায় পাশেই আলোর সুইচটা ছিল, আলো জ্বেলে দেখলেন ঘরের ভিতরে যাত্রী নেই! ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলেন, রাত তখন তিনটে। এত রাত্রে যাত্রী কোথায় গেল? ভাবতে ভাবতে তিনি নেমে গিয়ে বৈঠকখানার ভিতরে ঢুকলেন। তারপর ওষুধের শিশিটা নিয়ে ফিরে আসবার সময় তার চোখ পড়ল সদর দরজায় উপরে। সদর দরজায় ভিতর দিকের খিল খোলা! মিস্টার দাসের বেশ মনে পড়ল, তিনি নিজের হাতে খিল লাগিয়ে দিয়ে গেছেন।
কিছুই আর বুঝতে বাকি রইল না। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে মিসেস দাসকে ডেকে তিনি বললেন, ওগো, শুনচ? ব্যাপার গুরুতর!
মিসেস দাস তাড়াতাড়ি উঠে বসে বললেন, তার মানে?
রতনবাবুর কথাই ঠিক। আমাদের এই নতুন ভাড়াটেটা হয় খুনি, নয় ডাকাত, নয় স্বদেশি বোমাওয়ালা।
মিসেস দাস এবারে দাঁড়িয়ে উঠে আবার বললেন, তার মানে?
সে লোকটা ঘরে নেই। সদর দরজা খোলা। এই নিশুত রাতে বাড়ির বাইরে সে কি করতে গেছে?
মিসেস দাস হাত-মুখ নেড়ে বললেন, তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না।
তাহলে নিজের চোখে দেখবে এসো।
দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে সঙ্গেই শুনলেন, সদর-দরজা খোলার ও বন্ধ করার শব্দ! দুজনেই বিস্মিত হয়ে দুজনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন–কেউ কিছু বললেন না।
দুজনে যখন সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, হঠাৎ ফাঁচ করে হাঁচির শব্দ হল!
মিস্টার দাস ভাবলেন, তার স্ত্রী বোধহয় হেঁচে ফেললেন। মিসেস দাসের ধারণা হল ঠিক উলটো–এ হাঁচি নিশ্চয়ই তাঁর স্বামীর!
মিসেস দাস যখন যাত্রীর ঘরের কাছে এসেছেন, তখন ঠিক তার কাঁধের উপরে আবার কে হেঁচে দিলে। এবারে চমকে মুখ ফিরিয়ে তিনি দেখলেন, মিস্টার দাস তাঁর কাছ থেকে প্রায় দশ-বারো হাত তফাতে আছেন! অথচ হাঁচির শব্দ হল ঠিক তার কানের কাছেই! মিসেস দাস অত্যন্ত বিস্মিত হলেন, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না।